অনীতা বুঝতে পারছিল মামি তাকে নিয়ে মজা করছে। ঘরে ঢুকে চোখে হাসি ফুটিয়ে সে বলেছিল, কী রকম?
কত দিন তুই আমাদের বাড়ি আসিস না। সেদিন অবুকে বাড়ির দোর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলি। কিন্তু ভেতরে আসার সময় পেলি না–আঁ?
অনীতা মুখ কাঁচুমাচু করে হাত কচলাতে কচলাতে বলেছিল, এই তো এলাম। এবার থেকে রোজ আসব। তোমরা তো জানো, তোমাদের এখানে এলে আমার কত ভালো লাগে।
দেখব কেমন আসিস। এখন বল কী খাবি?
কিচ্ছু না। একটা কথা বলেই আজ চলে যাব।
মামা বলেছিলেন, কথাও বলবি, মিষ্টিও খাবি। আমরা এখনও বিকেলের চা-টা খাইনি। ভালোই হয়েছে; একসঙ্গে খাওয়া যাবে।
মামি সবার জন্য চা আর খাবার-দাবার নিয়ে এসেছিলেন। খেতে খেতে অনীতা বলেছিল, আজ সন্ধেবেলা তোমরা আমাদের বাড়ি যাবে, বাবা বিশেষ করে বলে দিয়েছে। আমাদের ওখানে রাত্তিরে খেয়ে আসবে। বাবা একটা কাজে আটকে গেছেন বলে আসতে পারলেন না। অবনীনাথের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, আপনিও যাবেন কিন্তু।
মামা দারুণ খুশি হয়ে গিয়েছিলেন, যাক, একটা নেমন্তন্ন পাওয়া গেল। ডান হাতের ব্যাপারটা ভালোই হবে। কিন্তু হঠাৎ তোর বাবা লোক ধরে ধরে খাওয়াচ্ছে কেন রে? অকেশনটা কী?
অনীতা বলেছিল, গেলেই দেখতে পাবেন।
তুই তাহলে বলবি না! ঠিক আছে, সন্ধে পর্যন্ত সাসপেন্সেই থেকে যাই।
অনীতা উত্তর না দিয়েই হেসেছিল একটু।
মামা আবার বলেছিলেন, একটা কথা অন্তত বল–
অনীতা জানতে চেয়েছে, কী?
তোদের বাড়ি আজ কী মেনু হচ্ছে? আমি অতশত জানি না। তবে বাবাকে নিউ মার্কেট থেকে মুরগির মাংস আনতে দেখেছি।
আজ আমাদের নিরামিষ হয়েছে। তোর কাকিমা ঘাট আর ডাঁটা চচ্চড়ি-মচ্চড়ি কী যেন বেঁধেছে। ওসবের নামে জ্বর আসছিল। যাক, ডাঁটার বদলে রাত্তিরে মুরগির ঠ্যাঙ চিবুনো যাবে। গ্রান্ড।
মামি মামার সম্পর্কে বলেছিল খালি খাওয়া আর খাওয়া। লোকটার সারা শরীরে জিভ আর পেট ছাড়া আর কিছু নেই।
কথাটা ষোলো আনার জায়গায় আঠারো আনা সত্যি। মামা মানুষটির মনটা খুবই বড় মাপের। খেতে যেমন পারতেন তেমনি খাওয়াতেও। কদিনেই অবনীনাথ টের পেয়ে গিয়েছিলেন, নিজের হাতে বাজার করাটা ছিল তাঁর দারুণ শখ। বাজারে ঘুরে ঘুরে সেরা আনাজ, সেরা ফল আর সেরা মাছ কি মাংস তাঁর আনা চাই। তবে যেদিন অফিসে জরুরি কাজ থাকত সেদিন আর বাজারে যাওয়া হত না মামার।
এলোমেলো আরও কিছুক্ষণ কথার পর অনীতা বলেছিল, এবার যাই। যেতে গিয়েও হঠাৎ কী মনে পড়ে যেতে সে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। অবনীনাথের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, জানেন নিশ্চয়ই, নেক্সট উইক থেকে ক্লাস শুরু হয়ে যাচ্ছে।
অবনীনাথ বলেছিলেন, কই না, শুনিনি তো।
আমি কাল ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম। জেনে এসেছি।
অবনীনাথ এবার আর উত্তর দেননি।
অনীতা ঠোঁট টিপে এবার বলেছিল, ক্লাস শুরু হলে আপনাকে কি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে? কৌতুকে তার দুচোখ চিকচকিয়ে উঠেছিল।
মজাটা কোন দিক থেকে অনীতা করেছে, বুঝতে অসুবিধা হয়নি অবনীনাথের। গ্রাম থেকে এসেছেন বলে তিনি একটা অপদার্থ নন যে একা একা বকুলবাগান থেকে কলেজ স্ট্রিট যেতে পারবেন না। আস্তে করে তিনি বলেছিলেন, নিয়ে যাবার দরকার নেই। আমি একাই যেতে পারব।
ফাইন। স্বাবলম্বী হওয়া ভালো।
অবনী কী উত্তর দিয়েছিলেন, এতদিন পর আর মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে সন্ধেবেলা অনীতাদের বাড়ি যেতে হয়েছিল। তাঁর যাবার খুব একটা ইচ্ছা ছিল না। ভয় হয়েছিল, অনীতা হয়তো এমন কোনো মজার কথাটথা বলে বসতে যাতে লজ্জায় তিনি কারো দিকে তাকাতে পারবেন না। কিন্তু মামা-মামি ছাড়েননি, জোর করে তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন।
অনীতাদের বাড়িটা খুব বেশি দূরে নয়। মামাদের বাড়ির সামনে দিকে যে রাস্তাটা দক্ষিণ দিকে চলে গেছে সেটা ধরে মিনিট তিনেক হাঁটলে একটা বাঁক, বাঁকের পর চারখানা বাড়ি ছাড়িয়ে ওদের ছিমছাম ছোট্ট দোতলা বাড়িটা।
একতলায় অনীতাদের বসবার ঘরটা বেশ বড় আর চমৎকার করে সাজানো। সেখানে কয়েকজন পুরুষ, মহিলা আর দু-তিনটে ছোট ছেলেমেয়ে গল্প করছিল।
অবনীনাথরা ওখানে আসতেই মধ্যবয়সি সুপুরুষ চেহারার একটি ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, আসুন আসুন ব্যানার্জিসাহেব, আসুন মিসেস ব্যানার্জি-অবনীনাথকে দেখিয়ে বলেছিলেন, এ নিশ্চয়ই আপনার ভাগ্নে।
মামা বলেছিলেন, হ্যাঁ।
ভদ্রলোক আবার বলেছিলেন, কারেক্ট ধরেছি। অনীতা যা ডেসক্রিপশান দিয়েছে তাতে চিনতে অসুবিধা হয়নি।
অবনীনাথ আন্দাজ করতে পেরেছিলেন, ইনি অনীতার বাবা। তবে ভেতরে ভেতরে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন। নিশ্চয়ই তাঁকে একটা ক্লাউন বানিয়ে সবাই খুব হাসাহাসি করেছে।
যাই হোক, অবনীনাথরা বসার পর আলাপ পরিচয় শুরু হয়েছিল। ওই ঘরে এক মাত্র অনীতা ছাড়া আর সবাই ছিল তাঁর অচেনা। অনীতার বাবা রেলের অ্যাকাউন্টস অফিসার। এ ছাড়া ছিলেন অনীতার এক কাকা, এক পিসেমশাই আর পিসিমা, তিনজন কলেজের বন্ধু-লীলা, মালতী আর অরুন্ধতী, ছোট দুটি ভাই–পিন্টু ঝিন্টু এবং মা আর একটি কোট-প্যান্ট-টাই পরা ঘাড়ে-গানে ঠাস যুবক। যুবকটির নাম নবকুমার।
অনীতার মায়ের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন অবনীনাথ। অনীতা তাঁরই সমবয়সি অর্থাৎ বাইশ-তেশই হবে কিন্তু তার মায়ের বয়স খুব হলে ত্রিশ-বত্রিশ। ছোট দুই ভাইয়ের একজনের বয়স সাত-আট হবে, আরেক জনের বয়স বড়জোর চার পাঁচ। যত কম বয়েসেই সেকালে বিয়ে হোক তিরিশ বছর বয়সের মায়ের তেইশ বছরের তরুণী মেয়ে থাকা একেবারেই অসম্ভব।