অনীতার মতো একটা ঝকঝকে মেয়ের সঙ্গে ওইরকম সাজপোশাক, চুলের ছাঁট, মাথায় মাঝ বরাবর সিঁথি, পায়ে লাল কেড়স নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে একেবারে কুঁকড়ে ছিলেন অবনীনাথ। ভয়ে ভয়ে এবার বলেছিলেন, হয়তো কোনো কাজে আপনার বন্ধু আটকে গেছেন। আরেকটু অপেক্ষা করলে
এক সেকেন্ডও আর ওয়েট করব না। চলুন তো
ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে ওঁরা সেনেট হলের উলটো দিকে যেতেই বাস এসে গিয়েছিল। সেই নাইনটিন থার্টি নাইনে একটা প্রাইভেট কোম্পানি কলেজ স্ট্রিট রুটে দোতলা বাস চালাত।
কলকাতায় তখন পপুলেশন এক্সপ্লোসান হয়নি; রাস্তাঘাটে এখনকার মতো গিজগিজে ভিড় দেখা যেত না। কলকাতা তখন ছিমছাম পরিচ্ছন্ন মেট্রোপলিস। প্রাইড অফ দি ইস্ট, সেকেন্ড সিটি অফ দি ব্রিটিশ এম্পায়ার–সারা পৃথিবীতে তখন কত নাম-ডাক তার।
দুপুরবেলা বাসটা প্রায় ফাঁকাই ছিল। একতলায় যদিও দু-চারটে লোক দেখা গেছে দোতলাটা একেবারে খালি। অনীতা অবনীনাথকে নিয়ে সোজা ওপরে উঠে একেবারে সামনের সিটে বসেছিল। অবনীনাথ অবশ্য অনীতার পাশে বসতে চাননি। পিছনের সিটটা দেখিয়ে বলেছিলেন, আমি ওখানে বসছি।
অনীতা বলেছিল, বা রে, আপনার সঙ্গে ভালো করে আলাপই হল না। বসে যেতে যেতে গল্প করব ভাবলাম। আপনি পিছনে বসলে মুখ ফিরিয়ে কথা বলতে বলতে ঘাড় ব্যথা হয়ে যাবে। এখানে বসুন তত। একরকম জোর-জার করেই অবনীনাথকে কাছে বসিয়েছিল অনীতা।
এভাবে একজন অনাত্মীয়া তরুণীর পাশাপাশি বসে আগে আর কোথাও যাননি অবনীনাথ। অনীতার ছোঁয়া বাঁচিয়ে নিজেকে যতটা সম্ভব গুটিয়ে জড়সড় হয়ে থাকতে থাকতে টের পাচ্ছিলেন, সারা শরীর বেয়ে গল গল করে ঘাম বেরুচ্ছে। এক মিনিটের ভেতর জামা-টামা ভিজে সপসপে হয়ে গিয়েছিল।
এক সময় বাস চলতে শুরু করেছিল। দুধারে নাইন্টিন থার্টিনাইনের কলকাতা। অনীতা বলেছিল, আপনি কী সাবজেক্টে অ্যাডমিশন নিলেন?
অবনীনাথ বলেছিলেন, ইংরেজি।
বি.এ-তে ইংলিশেই অনাস ছিল?
হ্যাঁ।
কোন ক্লাস পেয়েছিলেন?
ফার্স্ট ক্লাস~~
দ্রুত আরেকবার অবনীনাথের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়েছিল অনীতা। অনার্সে ফাস্ট ক্লাসের সঙ্গে তাঁর এই চেহারা এবং পোশাক-টোশাক যেন মিলিয়ে নিতে পারছিল না সে। আস্তে আস্তে তার চোখে সম্ভ্রমের ভাব ফুটে উঠতে শুরু করেছিল। অনীতা বলেছিল, কোন কলেজ থেকে অ্যাপিয়ার করেছিলেন?
শুধু কলেজ সম্পর্কেই নয় অবনীনাথদের ফ্যামিলি এবং বাড়ি-টাড়ি সম্পর্কেও অনেক কথা জিগ্যেস করেছে অনীতা। অবনীনাথ শ্বাসরুদ্ধের মতো পাশে বসে উত্তর দিয়ে গেছেন।
আধঘণ্টা বাদে হাজরার কাছে বকুলবাগানের স্টপেজ আসতেই অবনীনাথকে নিয়ে নেমে পড়েছিল অনীতা।
মেইন রোড থেকে মামাদের বাড়িটা অল্প দূরে; মিনিট তিনেকের রাস্তা। বাড়ির কাছে এসে অনীতা রগড়ের গলায় বলেছিল, এবার যেতে পারবেন তো? ঠাট্টা যে অবনীনাথ বুঝতে পারেননি তা নয়। মজা করে একটা উত্তর দেবার ইচ্ছাও তার হয়েছিল। কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরোয়নি।
অনীতা বলেছিল, আচ্ছা চলি। আশা করি আবার দেখা হবে। কাকিমাকে বলবেন দু-একদিনের ভেতর এসে হাজির হব। বলে আর দাঁড়ায়নি, রাস্তা ধরে সোজা সামনের দিকে চলে গিয়েছিল।
ভদ্রতা করে অনীতাকে বাড়িতে আসার কথা বলা উচিত ছিল। এতটা রাস্তা সে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। সে জন্য একটা ধন্যবাদও ছিল তার প্রাপ্য। কিন্তু আগে কিছুই মনে পড়েনি। পরে যখন মনে পড়ল, রাস্তার বাঁক ঘুরে অনীতা অদৃশ্য হয়ে গেছে।
মনে আছে, দিন সাতেক পর একটা দারুণ অস্বস্তিকর অবস্থায় আবার অনীতার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পরের দিনই মামা অবনীনাথকে নিয়ে নামকরা টেলারের দোকানে গিয়ে গোটাকতক শার্ট আর টাউজার্সের অর্ডার দিয়ে এসেছিলেন। মাঝখানে একদিন ট্রায়াল দিয়ে আসা হয়েছে। তারপর ঠিক এক সপ্তাহ বাদে সেদিন শার্ট-টার্ট ডেলিভারি আনা হয়েছিল।
বাড়িতে এনে অবনীনাথকে একটা ট্রাউজার্স আর শার্ট পরিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলেন মামা আর মামি। এদিকে মামা আরেকটা কাণ্ড করেছিলেন, বাড়ি থেকে আসার পরই অবনীনাথের চুল কাটা আর দাড়ি কামানো তাঁর অর্ডারে পুরোপুরি বন্ধ। কদিনে ছোট ছোট চুল আরেকটু বড় হয়েছে, জুলপিও খানিকটা গজিয়ে গেছে। সেদিন মামার ডিরেকশানে জুলপি রেখে দাড়ি কামিয়েছেন অবনীনাথ। মাথার মাঝখান থেকে সিঁথিটা বাঁদিকে টান্সফার করা হয়েছিল।
যাই হোক, টাউজার্স-ফাউজার্স পরিয়ে যখন অবনীনাথকে দেখা হচ্ছে সেই সময় কখন যে অনীতা দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ লক্ষ করেননি।
আচমকা উচ্ছ্বসিত হাসির শব্দে চমকে সবাই ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে ছিলেন। আর তাকিয়েই কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে গিয়েছিলেন অবনীনাথ।
হাসতে হাসতে অনীতা বলেছিল, আরে বাবা, চেনাই যাচ্ছে না দেখছি। একেবারে টোটাল রেভলিউশানারি চেঞ্জ।
মামাও হেসে হেসে বলেছিলেন, এখন থেকে কথাকাতায় থাকবে তো। অবুটার গায়ে শহরের বার্নিশ লাগাচ্ছি।
অবনীনাথের মরে যেতে ইচ্ছা করছিল। কদিন আগে ইউনিভার্সিটিতে এই মেয়েটির কাছে প্রচুর লজ্জা পেয়েছিলেন অবনীনাথ। সাত দিন বাদে আবার সেই ব্যাপার ঘটল।
যাই হোক, অবনীনাথের নতুন সাজ-পোশাকের বহর বা তাঁর চুলের নতুন ছাঁট নিয়ে রগড়টা বেশি দূর এগোয়নি। মামা আর মামি একটু পরেই অনীতাকে নিয়ে পড়েছিল। মামি বলেছিলেন, কী রে মেয়ে, বি.এ পাশ করার পর তো বুঝি নতুন পা গজিয়েছে।