অফিসে সেদিনে খুব জরুরি একটা কাজ ছিল মামার। আগে থেকেই তিনি ঠিক করে রেখেছিলেন অবনীনাথকে ভর্তি করে সোজা অফিসে চলে যাবেন। আর অবনীনাথ বকুলবাগানে ফিরে আসবেন। কিন্তু একা একা কলকাতার রাস্তায় চলাফেরা অভ্যাস তখনও হয়নি তাঁর। মামা একটু চিন্তিতভাবেই জিগ্যেস করেছিলেন, বাসে তুলে দিলে বাড়ি ফিরতে পারবি তো?
ভাবনা যে একেবারে হচ্ছিল না তা নয়। কিন্তু বাইশ বছরের একটি যুবকের কলেজ স্ট্রিট থেকে ভবানীপুরের বকুলবাগানে একা ফিরতে না পারাটা খুবই লজ্জার কথা। অবনীনাথ বলেছিলেন, পারব।
চল তা হলে
দ্বারভাঙা বিল্ডিং থেকে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন মামা। তারপর খুশিতে প্রায় চেঁচিয়েই উঠেছিলেন, আরে অনুতাঁর চোখ-মুখে হাসি ঝকমকিয়ে উঠেছিল।
ততক্ষণে অবনীনাথও দেখতে পেয়েছেন। তাঁরই প্রায় সমবয়সি একটি মেয়ে নীচ থেকে উঠে আসছিল। মামাকে দেখে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করেছিল মেয়েটি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কাছে চলে এসেছিল সে।
মেয়েটির গায়ে রং আশ্বিনের রৌদ্র-ঝলকের মতো। পানপাতার মতো ভরাট মুখ, চোখ দুটো যেন রুপোর কাজললতা, ছোট কপালের ওপর থেকে ঘন চুলের ঘের, গলাটা নিভাঁজ মসৃণ। তার চোখে মুখে হাসির আভা লেগেই আছে। ঘড়ি ছাড়া সারা গায়ে গয়না বলতে কিছু নেই। কাঁধ থেকে চমৎকার কাজ করা একটা কাপড়ের ব্যাগ ঝুলছে।
মামা আবার বলেছিলেন, অ্যাডমিশানের জন্যে এসেছিস নাকি?
বন্ধু আজ ভর্তি হবে। ও আসতে বলেছিল, তাই।
তোদের ক্লাস কবে থেকে আরম্ভ হচ্ছে?
এই তো সবে অ্যাডমিশান শুরু হল। এ সব মিটুক। এক মাসের আগে ক্লাস শুরু হবে। বলে তো মনে হয় না।
মামা বলেছিলেন, তোমার ওপর আমি কিন্তু ভীষণ রাগ করেছি বাপু।
মেয়েটি হেসে বলেছিল, দশ-বারো দিন আপনার বাড়ি যাইনি বলে তো?
হ্যাঁ। বি.এ-র রেজাল্ট বেরুবার পর সেই যে একবার এলি, তারপর আর পাত্তা নেই।
কী করব কাকু, আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি বাড়ি প্রণাম করতে যেতে হল। বন্ধু-বান্ধবরা দুবেলা আসতে লাগল। তাই।
ঠিক আছে। এবার থেকে যেন রেগুলার দেখতে পাই।
মেয়েটি ঘাড় কাত করে দিয়েছিল, রেগুলারই দেখতে পাবেন। একটু থেমে কী ভেবে ফের বলেছিল, কিন্তু কাকু, আপনি হঠাৎ ইউনিভার্সিটিতে?
এতক্ষণে অবনীনাথের কথা খেয়াল হয়েছিল মামার। ব্যস্তভাবে তাঁকে দেখিয়ে মেয়েটিকে বলেছিলেন, ওর অ্যাডমিশানের ব্যাপারে এসেছিলাম। ওই দেখ, এখনও তোদের আলাপটাই করিয়ে দেওয়া হয়নি। এ হল আমার ভাগনে অবনী। মেয়েটি সম্বন্ধে অবনীনাথকে বলেছিলেন, আর এ হল অনু–অনীতা। এ বছর হিস্ট্রি অনার্স নিয়ে পাশ করেছে।
অনীকে দেখার পর থেকেই পলকহীন তাকিয়ে ছিলেন অবনীনাথ। এমন স্মার্ট সাবলীল মেয়ে আগে আর কখনও দেখেননি তিনি।
ওদিকে অনীতা একপলক তাকিয়ে হাতজোড় করে হাসিমুখে বলেছিল, নমস্কার।
মেয়েদের সঙ্গে মেশার অভ্যাস ছিল না অবনীনাথের। তা ছাড়া অনীতার মতো মেয়ে আগে তিনি চোখেই দেখেননি। হকচকিয়ে গিয়ে কোনোরকমে দুহাত তুলে জড়ানো গলায় বলেছিলেন, নমস্কার।
এদিকে একটা কথা মনে পড়ে গিয়েছিল মামার। অনীতাকে বলেছিলেন, তোর সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভালো হয়েছে। কতক্ষণ তুই ইউনিভার্সিটিতে থাকবি?
বেশিক্ষণ না। কেন?
সোজা বাড়ি চলে যাবি তো?
হ্যাঁ।
তা হলে এক কাজ করিস; অবুকে সঙ্গে করে নিয়ে যাস। আমাকে এক্ষুনি অফিসে ছুটতে হবে। অবুটা কলকাতায় একেবারে আনকোরা, রাস্তা-টাস্তা কিছুই চেনে না। আমাদের বাড়িতে ওকে একটু পৌঁছে দিস।
চোখের কোণ দিয়ে অবনীনাথকে আবার দেখেছে অনীতা। তার চোখে গোপন কৌতুকের একটু হাসি চকমকিয়ে উঠেছিল। একটি বাইশ-তেইশ বছরের যুবক কলকাতার এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় একা যেতে পারে না, তার কাছে এটা দারুণ মজার ব্যাপার। ঠোঁটের কোণ কামড়াতে কামড়াতে সে বলেছিল, নিশ্চয়ই পৌঁছে দেব। আপনি চলে যান কাকু।
অবনীনাথ কারো দিকে তাকাতে পারছিলেন না। চোখ নীচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। লজ্জায় নাক মুখ ঝাঁ ঝাঁ করছিল তাঁর। এমন বিশ্রী অবস্থায় আগে কখনও পড়েননি। মামা সরল মনে তাঁর ভালো করতে গিয়ে কী কাজ যে করে গিয়েছিলেন তিনি নিজেই জানেন না।
যাই হোক। মামা আর দাঁড়াননি; অবনীনাথকে অনীতার হাতে গচ্ছিত রেখে চলে গিয়েছিলেন। আর অনীতা আরও দু-একবার অবনীনাথের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, আসুন আমার সঙ্গে।
সিঁড়ি ভেঙে অনীতার সঙ্গে আবার ওপরে উঠতে উঠতে অবনীনাথ টের পেয়েছিলেন, হৃদপিণ্ডের উত্থান পতন দ্রুততর হয়ে উঠছে। পা দুটো ভীষণ কাঁপছিল তাঁর।
চলতে চলতে অনীতা বলেছিল, বন্ধুর সঙ্গে দেখা করেই চলে যাব। ম্যাক্সিমাম হাফ অ্যান আওয়ার কি ফর্টি মিনিটস এখানে থাকব। আপনার অসুবিধা হবে না তো?
আড়ষ্ট গলায় অবনীনাথ কোনোরকমে বলেছিলেন, না।
মনে আছে, প্রায় ঘণ্টাখানেক অনীতার পিছু পিছু দ্বারাভাঙা বিল্ডিং, আশুতোষ বিল্ডিং আর সেনেট হলে ঘুরেছিলেন অবনীনাথ কিন্তু যার জন্য এত ঘোরাঘুরি তাকে পাওয়া যায়নি। অনীতা একটু হতাশ এবং বিরক্ত হয়েই বলেছিল, দেখুন তো, বিশাখাটা এল না, শুধু আমাকে ছুটিয়ে আনল।
অবনীনাথ অবস্থা গলায় কিছু একটা বলেছিলেন, বোঝা যায়নি।
অনীতা বলেছিল, একবার দেখা হোক, বিশাখাকে মজা দেখিয়ে ছাড়ব। আমার অনেক কাজ ছিল, সব ফেলে এলাম। কোনো মানে হয়! যাক গে, আপনাকে দিয়ে অনেক সিঁড়ি ভাঙিয়েছি, আর না। চলুন–