মা অবাক, অবু তাহলে থাকবে কোথায়?
আমাদের কাছে। বলে একটু থেমে মামা ফের বলেছিলেন, তোর সাহস দেখে আমি থ হয়ে যাচ্ছি। দাদার কাছে ছেলেকে নিয়ে এসে বলছিস থাকার জায়গা খুঁজে দিতে।
মা কুণ্ঠিত মুখে বলেছিলেন, কিন্তু
মামি এবার বলেছিলেন, কোনো কিন্তু না। আমাদের না জানিয়ে অবুকে মেসে বা হস্টেলে রাখতে, সেটা নাহয় মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু সব জানার পর ওকে মেসে পাঠানো চলবে না।
মামা বলেছিলেন, মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাবার পর এত বড় বাড়িটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। অবু এখানে থাকলে আমাদের খুব ভালো লাগবে।
এর পরও মা কিছু বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু মামা-মামি বলতে দেননি। সুতরাং অবনীনাথ বকুলবাগানেই থেকে গিয়েছিলেন।
মনে আছে, দিন দুয়েক বাদে মাকে লোক দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে মামা তাঁকে নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলেন।
এর আগে কলকাতায় চার-পাঁচবারের বেশি আসেননি অবনীনাথ। বার দুই মাকে নিয়ে কালীঘাটে, একবার ছেলেবেলায় জ্ঞাতিকাকার সঙ্গে একবার চিড়িয়াখানা এবং মিউজিয়াম দেখতে, আর বার তিনেক আত্মীয়স্বজনের বিয়েতে। এখনকার মতো সেকালে গ্রাম-টাম থেকে কলকাতায় যাতায়াতের এত চল ছিল না।
আগে যে কবার অবনীনাথ কলকাতায় এসেছিলেন তাতে এ শহরকে ভালোভাবে দেখার সুযোগ পাননি। পুরোনো গথিক স্ট্রাকচারের বিরাট বিরাট থাম আর সিঁড়িওলা সিনেট হল, দ্বারভাঙা বিল্ডিং, আশুতোষ বিল্ডিং, ইউনিভার্সিটি কম্পাউন্ডে মোটা মোটা পামের সারি, ঝকঝকে স্মার্ট চেহারার সব যুবক যুবতী এসব দেখতে দেখতে এ শহরে প্রায় আনকোরা মফস্সলের এক যুবক যতটা অবাক ঠিক ততটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
ইউনিভার্সিটিতে ঢোকার পর থেকেই অবনীনাথ লক্ষ করেছিলেন, চারপাশের ছেলেমেয়েদের অনেকেই তার দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে মজাদার ভঙ্গি করে হাসছে। আর কী যেন বলাবলি করছে। ব্যাপারটা মামার চোখেও পড়েছিল। কারণটা বুঝতে দুজনেরই অসুবিধা হয়নি।
জন্মের পর থেকে গ্রামে থেকেছেন অবনীনাথ। কলেজে পড়বার সময় বাঁকুড়ায় অবশ্য কটা বছর থাকতে হয়েছে কিন্তু তখনকার বাঁকুড়া শহর একটা বড় ধরনের গ্রাম ছাড়া আর কিছু নয়। তার চরিত্র চালচালন বা জীবনযাত্রায় সাময়িক স্ট্যাম্প মারা ছিল না। তখন গ্রামে বা দূর মফস্সল শহরে টাউজার্স বা জামা-টামা ঢোকেনি। কলকাতার ফ্যাশন-ট্যাশন ছিল ওখানে অচ্ছুৎ।
সেটা নাইটটিন থার্টি নাইন। সেকেন্ড গ্রেট ওয়ার তখনও শুরু হয়নি। তবে কলকাতায় বসে ইউরোপের বাতাসে বারুদের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
প্রায় চল্লিশ বছর আগে অবনীনাথ নামে যে যুবকটি সেদিন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে এসেছিল তার চেহারা এবং সাজপোশাক ছিল দেখবার মতো। ছোট ছোট করে ছাঁটা চুলে জবজবে করে তেল মাখা। মাথার মাঝখান দিয়ে সিঁথি চলে গেছে; নাকের তলায় মোটা গোঁফ। জুলপি বলতে কিছু নেই। একেবারে কানের কাছ থেকে নীচের দিকে চুল চেঁছে ফেলা হয়েছে। পরনের ডবল কাফ দেওয়া বেপ ফুল শার্ট আর খাটো ধুতি। শার্টটার হাতার বোতাম তো বটেই, গলার বোতাম পর্যন্ত আটকানো রয়েছে। বুক পকেটে ঘড়ি রাখার ফোঁকরও আছে। ধুতির কোঁচাটা সামনের দিকে ঝুলছে। এ ছাড়া পায়ে মোজা। এবং চল্লিশ বছর আগেকার বাংলাদেশের গাঁ অবনীনাথের সারা শরীরে তার মার্কা দিয়ে রেখেছে।
মামা তাঁর দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলেছিলেন, এসব ড্রেস চলবে না অবু। হেড টু ফুট তোকে একেবারে বদলে ফেলতে হবে। নইলে ক্লাস করতে এসে ছেলেরা তোর পেছনে লাগবে। একটু থেমে পরক্ষণে আবার বলেছিলেন, আজ অফিস থেকে ফিরে টেলারের কাছে নিয়ে যাব। কটা টাউজার্স আর শার্ট করিয়ে দিতে হবে। কেড়স চলবে না; ওটার বদলে চপ্পল-টপ্পল কিনে ফেলব। আর চুলটার তো সর্বনাশ করে রেখেছিস। ওগুলো বড় না হলে জুলপি বানানো যাবে না। আর তোর ওই কাঁকড়া গোঁফটা একেবারে ইম্পসিবল; ওটা টোটালি মাইনাস করে দিতে হবে।
গোঁফ সম্পর্কে খানিকটা মায়া ছিল অবনীনাথের কিন্তু কী আর করা যাবে। শরীরের একটা-দুটো জুলপি গজালে প্রফিট বা লস কোনোটাই নেই। ওটাও নাহয় মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে শার্ট, টাউজার্স আর চপ্পল-টপ্পল নিয়ে। এগুলো কিনতে পয়সা লাগে। অবনীনাথ নিজের অবস্থা জানেন। একে তো মামার কাছে আছেন। যদিও ওঁরা খুবই যত্নে এবং আদরের মধ্যে তাঁকে রেখেছেন, তাঁদের আন্তরিকতা এবং আপন-করা ব্যবহারে যদিও কোথাও বিন্দুমাত্র ক্রটি নেই তবু ভেতরে ভেতরে কিছুটা বিব্রত হয়েই থাকতেন অবনীনাথ। তার ওপর যদি মামা আবার এত সব পোশাক-টোশাক কিনে দেন, তা সেটা হবে খুবই লজ্জার ব্যাপার।
অবনীনাথ উত্তর দেননি। অপরিসীম কুণ্ঠায় মুখ নীচু করে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আশুতোষ বিল্ডিংয়ের লম্বা করিডর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন।
তাঁর মনোভাব কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন মামা। গভীর স্নেহে কাঁধের ওপর একটা হাত রেখে বলেছিলেন, বোকা ছেলে, মামার কাছ থেকে নিতে লজ্জা কীসের? তোর বাবা দিলে নিতিস না?
এর আর কিছু বলার থাকে না। অবনীনাথের মনে মামার সম্বন্ধে শ্রদ্ধা, মুগ্ধতা এবং কৃতজ্ঞতা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায় মাত্র।
যাই হোক অবনীনাথের সাবজেক্ট ছিল ইংরেজি। হেড অফ দি ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে দেখা করে তাঁর রেকমেন্ডেশন নিয়ে অ্যাডমিশন ফর্ম ফিল-আপ করে ভর্তির টাকা জমা দিতে দিতে ঘন্টাখানেক লেগে গিয়েছিল।