কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও সংসারের ধস তিনি ঠেকাতে পারেননি। প্রচণ্ড বদরাগী হঠকারী তান্ত্রিক স্বামী তাঁর খেয়ালখুশি মেটাতে যখন ইচ্ছা জমি বাঁধা দিতেন; তারপর চক্রবৃদ্ধিহারে সুদের দায়ে এক বিঘে দুবিঘে করে যেতে যেতে তাঁর অংশের জমি দ্রুত কমে আসতে শুরু করেছিল। এই নিয়ে বাবার সঙ্গে মা-র প্রায়ই ঝগড়া লেগে থাকত। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিল জীবনভর যুদ্ধের। কিন্তু বেহিসাবি বেপরোয়া বাবাকে আটকাবার শক্তি মায়ের ছিল না।
স্বামী সম্পর্কে হতাশ হবার পর মায়ের চোখ এসে পড়েছিল বড় ছেলে অবনীনাথের ওপর। ভেবেছিলেন সব জমিজামা একেবারে হাতছাড়া হবার আগেই যদি ছেলেটা মানুষ হয়ে যায়। একটা ছেলে দাঁড়িয়ে গেলে বাকিগুলোকে সে-ই টেনে তুলবে।
বাবা মনে করতেন, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার মতো একটা বাজে ব্যাপারে পয়সা খরচ করার কোনো মানে হয় না। কিন্তু মা প্রায় সব দিক থেকে হেরে গেলেও এই একটা জায়গা থেকে একচুল নড়েননি। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে যুদ্ধ করে গেছেন। দারুণ ছাত্র ছিলেন অবনীনাথ। ম্যাট্রিক পাশ করে বাঁকুড়া ক্রিশ্চান কলেজ থেকে ফার্স্ট ক্লাস অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েট হলেন তখন বাবার রক্তের তেজ শতকরা নব্বই ভাগ মরে গেছে। এদিকে জমিজমাও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। টের পাওয়া যেত খুব কষ্টেই দিন চলছে তাঁদের।
পর পর ভাইবোনগুলোও লেখাপড়া করে যাচ্ছিল। মায়ের শরীর তখন ভেঙে পড়েছে। কী করে যে সংসার চালিয়ে এতগুলো ছেলেমেয়ের লেখাপড়া টেনে গেছেন তিনিই একমাত্র জানেন।
জীবনের একেবারে শেষ হরাইজনের কাছে পৌঁছে বাবাও বদলে যেতে শুরু করেছিলেন। টাকাপয়সা ঢালা যাচ্ছিল না বলে তান্ত্রিক কাঁপালিকরা অনেক আগেই উধাও হয়েছিল। থিয়েটারের দল কবেই ভেঙে গেছে। তবে বাজারের কেষ্ট সাহার দোকান থেকে রোজ এক পাট করে দিশি মদ আনিয়ে মা কালীর পটের সামনে মড়ার খুলিতে ঢেলে কারণ করে খেতেন বাবা। যাই হোক, গ্র্যাজুয়েট ছেলের দিকে তাকিয়ে তাঁর এত দিনে মনে হয়েছিল, তাঁর প্রচুর বাধা এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্ত্রী এই ছেলেটাকে অত্যন্ত মূল্যবান একটা অ্যাসেট তৈরি করে তুলেছে। জমিজমা সবই প্রায় গেছে, যাক। এই ছেলেটাকে ধরে সংসারটা আবার দাঁড়াতে পারে। গলার স্বরে বীরভূমের রুক্ষ অথচ মিষ্টি একটা টান দিয়ে বলেছিলেন, তুমার গর্ভধারিণী একটা কাজের মতন কাজ করেছে বটে। লিখাপড়া করতে না পাঠিয়ে আমি সর্বনাশটিই করে দিচ্ছিলাম। পুরানো চাল, পুরানো দিন চলে গেছে। এখন লেখাপড়াটা বড় দরকার হে। আমার আগে তুমার মার চক্ষু ফুটেছিল তাই রক্ষা।
জীবন সম্পর্কে ধ্যানধারণা বদলে যাবার পর নতুন চোখে পৃথিবীটাকে দেখতে শুরু করেছিলেন বাবা। গ্রামের দিকে তখন ঘরে ঘরে লেখাপড়ার চল। ভেবেছিলেন বাড়ির একটা ছেলেই না, অন্য সবাইও মানুষ হোক। কিন্তু ব্যাপারটা এত দেরিতে তিনি বুঝেছিলেন যে তখন ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু করার ক্ষমতা ছিল না তাঁর। বাড়ি এবং অবশিষ্ট জমিজমা তখন পাশের গ্রামের এক উঠতি বড়লোকের কাছে বাঁধা পড়ে গেছে। সুদ আর আসল মিলিয়ে এমন একটা অঙ্ক দাঁড়িয়েছিল যাতে যে-কোনো দিন ক্রোকের নোটিশ এসে যাবার কথা।
বাবার ইচ্ছে ছিল, বি.এটা পাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতায় একটা চাকরি-টাকরি জুটিয়ে সংসারের দায়দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিক অবনীনাথ কিন্তু মা কিছুতেই রাজি হননি। বি.এ-তে এত ভালো রেজাল্ট করার পর আচমকা মাঝপথে পড়াটা বন্ধ হয়ে যাবার কথা তিনি ভাবতেও পারেননি।
কিন্তু কলকাতায় না গেলে এম.এ পড়া সম্ভব নয়। প্রায় একশো মাইল দূর থেকে ভেইলি প্যাসেঞ্জারি করে সেকালে কলকাতায় পড়তে আসার কথা ভাবা যেত না। ইউনিভার্সিটিতে পড়তে হলে কলকাতায় থাকতে হয়। অবনীনাথের বাবা বলেছিলেন, কলকাতায় ছেলেকে রেখে পড়ার খরচ চালাবে কী করে?
মা বলেছিলেন, যেভাবে হোক আর যত কষ্টেই হোক, দুটো বছর চালাতেই হবে। মনে আছে, মা অবনীনাথকে সঙ্গে করে নিয়ে কলকাতার বকুলবাগানে তাঁর এক জেঠতুতো দাদার বাড়িতে চলে এসেছিলেন।
মায়ের এই দাদা অর্থাৎ অবনীনাথের মামা মানুষটি চমৎকার–যেমন হৃদয়বান তেমনি আমুদে আর হাসি-খুশি। মামিও ভারী ভালোমানুষ, খুবই স্নেহপ্রাণ। গোলগাল আদুরে ধরনের চেহারা। একটিমাত্র মেয়ে ওঁদের। বিয়ে হয়ে গেছে, তখন স্বামীর সঙ্গে টাটানগরে থাকত।
হঠাৎ খুড়তুতো বোন এবং তাঁর ছেলেকে দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন মামারা। মা মামাকে বলেছিলেন, দাদা, অবুকে নিয়ে এসেছি। দুটো উপকার তোমাকে করে দিতে হবে।
মামা হেসেছিলেন, উপকার আবার কী রে! কত বছর পর তোকে দেখলাম। দাদার সঙ্গে সম্পর্ক তো আর রাখিস না। এখন বল কী করতে হবে। যা বলবি তা-ই করে দেব।
মা কাপড়ের একটা ঝোলা থেকে দেড়শো টাকা বার করে মামাকে দিতে দিতে বলেছিলেন, এটা রাখো। অবুকে এম.এতে ভর্তি করে দেবে আর ওর কলকাতায় থাকার জন্য একটা জায়গা ঠিক করে দিও। খুব বেশি টাকাপয়সা দিতে পারব না; আমাদের অবস্থা তুমি তো শুনেছ।
মামা বলেছিলেন, একটা কাজ আমি পারব, আরেকটা কাজ আমাকে দিয়ে হবে না।
বিমূঢ়ের মতো, মা মামার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
মামা বলেছিলেন, এম.এ.-তে দু-একদিনের মধ্যেই ভর্তি করে দিচ্ছি কিন্তু থাকার জন্য মেস-টেস খুঁজে দিতে পারব না।