সুদীপা এইসময় বলে, তুমি আমাদের চোখে ছোট হয়ে যাবে, এমন কোনও কথা আমরা শুনতে চাই না বাবা। তাকে খুবই বিচলিত দেখাতে লাগল।
অঞ্জন বলল, একষট্টি বছর যা তুমি বলোনি, তা আজ না-ই বা বললে। যে উঁচু পেডেস্টালে তোমাকে আমরা বসিয়ে রেখেছি সেখান থেকে নামাতে গেলে আমাদের ভীষণ কষ্ট হবে।
অভীক বলল, যা বললে আমরা দুঃখ পাব তা তুমি বোলো না বাবা।
মৃদুলা রঞ্জনা চৈতী এবং মৃন্ময়ও একই কথা বলল। শুধু চিরদীপ-ই চুপ করে রইল। সবে তিনমাস তার বিয়ে হয়েছে; একেবারে আনকোরা নতুন জামাই। তার কী যে বলা উচিত ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। ফলে তাকে ভীষণ বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে।
অবনীনাথ বললেন, বলতে আমাকে হবেই। এই বলার ওপর আমার সেই ডিসিশানটা নির্ভর করছে। একটু থেমে অন্যমনস্কর মতো আবার বললেন, টুথ ইজ ট্রুথ। তাকে ফেস করাই ভালো। ভেবে দেখো, আমার মৃত্যুর পর যদি কোনোরকমে আমার জীবনের একটা গোপন দিকের কথা তোমরা জানতে পারো তখন ভাববে আমরা এক শঠ প্রতারক চরিত্রহীন বাপের সন্তান হয়ে এই পৃথিবীতে বড় গ্লানি নিয়ে বেঁচে আছি। তখন সেলফ ডিফেন্স বা কৈফিয়ত দেবার জন্য আমি থাকব না। বেঁচে থাকতে থাকতেই নিজের কথা আমাকে বলে যেতেই হবে।
ছেলেমেয়ে, পুত্রবধূ বা জামাইরা কেউ কিছু বলল না।
খানিকক্ষণ চুপচাপ। তারপর অবনীনাথ অদৃশ্য পর্দা সরিয়ে তাঁর জীবনের অজানা দিক উন্মোচন করতে শুরু করলেন।
.
অবনীনাথদের দেশ বীরভুম ডিস্ট্রিক্টে; রামপুরহাটের কাছাকাছি একটা গ্রামে তাঁর বাবা ছিলেন ফিউডাল যুগের শেষ প্রতিনিধিদের একজন।
একদা সেই টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরির গোড়ার দিকে প্রায় এক হাজার একর জায়গা জুড়ে ছিল অবনীনাথের পূর্বপুরুষদের বিশাল জমিদারি। তারপর তিন জেনারেশান জনবল পাঁচ গুণ বেড়ে যাওয়ায় এবং জমিজমা ক্রমাগত ভাগ হতে থাকায় অবনীনাথের বাবার অংশ একশো বিঘেতে এসে ঠেকেছিল।
একশো বিঘে ফলবান ল্যান্ড প্রপার্টি কথার কথা নয়। ঠিকমতো কাজে লাগালে তাই দিয়ে আরও পাঁচশো বিঘে জমি বাড়ানো যায়। কিন্তু যার শরীরে কয়েক জেনারেশন ধরে সত্যিকারের ব্লু ব্লাড বইছে তার পক্ষে চাষবাস বা জমিজমার খোঁজ রাখা অনেক নীচু স্তরের কাজ। এই পৃথিবীতে সত্তর বছর বেঁচে গেছেন তিনি। এই দীর্ঘ সময়ে তিনটি কাজ দারুণ প্যাসান দিয়ে করেছেন। এক নম্বর, সন্তানের জন্মদান; অবনীনাথরা সবসুদ্ধ সাত ভাইবোন। দুনম্বর হল তন্ত্রসাধনা। বাবার জন্য অবনীনাথদের বাড়িটা তান্ত্রিক এবং কালীসাধকদের একটা হেড কোয়ার্টার হয়ে উঠেছিল। কাঁপালিকদের মতো বাবার কপালে গোলা সিঁদুরের প্রকাণ্ড ডগডগে ফোঁটা থাকত, গলায় ঝুলত রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে রুদ্রাক্ষের তাগা। তবে রক্তাম্বর পরতেন না। নিয়ম করে প্রতি সন্ধ্যায় দিশি মদ মায়ের প্রসাদি করে কারণবারি পান করতেন। সেই সঙ্গে প্রসাদি পাঁঠার মাংস। কারণ এবং মাংসের এই সেশানটা চলত মাঝরাত পর্যন্ত। দেশি মদের জন্যই কিনা কে জানে, যতক্ষণ জেগে থাকতেন বাবার চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে থাকত। বাবার তিন নম্বর অ্যাকটিভিটি হল যাত্রা। আশপাশের দশ-বিশটা মৌজার তাবৎ অ্যাক্টর জুটিয়ে একটা থিয়েটারের দল খুলেছিলেন তিনি। পুজোর সময়ে অষ্টমী আর নবমীর রাত্তিরে এবং পয়লা বৈশাখ মোট তিনখানা প্লে নামানো হত। তবে পুরোনো আমলের দো-মহলা বাড়ির বাইরের দিকের একটা ঘরে সারা বছর রিহার্সাল চলত।
তিনটে বড় অ্যাকটিভিটির মধ্যে প্রথমটা অর্থাৎ ছেলেপুলে দিয়ে ঘরবাড়ি বোঝাই করার কাজটা বিনা খরচাতেই হয়ে যেত। কিন্তু বাকি দুটো ব্যাপারে অর্থাৎ তন্ত্র সাধনা এবং থিয়েটারে জলের মতো পয়সা বেরিয়ে যেত। বাবার দৌলতে বাড়ির অবস্থা দাঁড়িয়েছিল পাটিগণিতের সেই চৌবাচ্চার অঙ্কের মতো। সেই যে চৌবাচ্চাটা যার দশটা ফুটো দিয়ে অনবরত জল বেরোয় কিন্তু চৌবাচ্চাটা বোঝাই করার কল শুধু একটাই।
তন্ত্র, থিয়েটার আর দিশি মদ নিয়ে দিনের পনেরো-ষোল ঘন্টা কেটে যেত বাবার। বাকি আট ঘণ্টা ঘুম বিশ্রাম স্নান খাওয়ার জন্য বরাদ্দ ছিল। এভাবে গোটা দিনটা যার কেটে যায় তাঁর পক্ষে ছেলেমেয়েদের দিকে নজর দেবার সময় থাকে না। বংশ পরম্পরায় এই ফ্যামিলিতে যা হয়েছে অবনীনাথ এবং তাঁর ভাই-বোনদের ভাগ্যেও তা-ই ঘটত। অযত্নে জঙ্গলের আগাছার মতোই তাঁরা বেড়ে উঠতেন। তারপর পুরুষানুক্রমে যা ঘটেছে বাপ ঠাকুরদার কার্বন কপি হয়ে তন্ত্র, দিশি মদ, প্রসাদি মাংস এবং থিয়েটারের দল নিয়েই কেটে যেত। কিন্তু তা হয়নি। তার কারণ মা।
অবনীনাথের মা ছিলেন বাবার একেবারে উলটো। তিনি এসেছিলেন গরিব স্কুলমাস্টারের ঘর থেকে। পেটে কিঞ্চিৎ কালির অক্ষর ছিল তাঁর। সে আমলে আপার প্রাইমারি পাশ করেছিলেন মা।
জীবন সম্পর্কে মা এবং বাবার অ্যাটিচুড ছিল একেবারে আলাদা। মা বুঝতে পেরেছিলেন অলস উড়নচন্ডী তান্ত্রিক এবং মদ্যপ স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ ঘোর অন্ধকার। যা করার নিজেকেই করতে হবে। সে আমলে মেয়েরা আজকালকার মতো এত প্রোগ্রেসিভ হয়নি। বাড়ি থেকে তাদের বাইরে বেরুবার চল ছিল না; বিশেষ করে গ্রামের দিকে। মা আড়ালে বসেই কিষাণ-টিষাণ লাগিয়ে চাষ-টাস করাতেন। জোর করেই ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। কলকাতা থেকে আশি-নব্বই মাইল দূরে এক পড়তি ফিউডাল ফ্যামিলির পুরোনো বাড়ির অন্দরমহলে বসে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে মারাত্মক সময় আসছে; সেখানে মাথা উঁচু করে টিকে থাকতে হলে ছেলেমেয়েদের পেটে কিছু লেখাপড়া ঢুকিয়ে দিতে হবে।