অবনীনাথ দুই স্ত্রীর আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন, কটা দিন পরস্পরকে নিয়ে তারা মেতে ছিল। নিজের হাতে কতরকম রান্না করে অনীতাকে কাছে বসে খাওয়াত চিন্ময়ী। অনীতাও তার জন্য কদিনেই স্কার্ফ বুনে দিয়েছিল। বিকেলে চিন্ময়ীকে জড়িয়ে ধরে বেড়াতে যেত সে। ওদের দেখতে দেখতে চোখে জল এসে যেত অবনীনাথের। কত ভালো ওরা, কত সুন্দর।
চিন্ময়ী একদিন অনীতাকে বলেছিল, তুমি আমাদের সঙ্গে কলকাতায় যাবে দিদি। তোমার ছেলেমেয়েদের তো দেখোনি? দেখে আসবে।
অনীতা প্রথমে রাজি হয়নি। চিন্মীয় অনবরত জোরজার করতে শেষ পর্যন্ত বলেছিল, আচ্ছা যাব।
কিন্তু কলকাতায় ফেরার আগের দিন ওদের দলের একজন অধ্যাপিকার হাতে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল অনীতা।-আমি পাটনায় ফিরে যাচ্ছি চিনু। কলকাতায় যাওয়া আমার পক্ষে উচিত না। আমি একটা সামান্য মেয়ে তো। ওখানে গেলে তোমার সুখের সংসার দেখলে আমার লোভ আর ঈর্ষা যে হবে না, এমন মনের জোর আমার আছে মনে করি না। অকারণ জটিলতা বাড়িয়ে কী হবে। তোমাকে আগে দেখিনি, তবে তোমার সম্বন্ধে কোনো কথা জানতে বাকি নেই। তোমাকে দেখে বুক ভরে গেছে। তোমার মতো একটা বোন পাওয়া কজনের ভাগ্যে ঘটে! এই পাওয়াটা যাতে হারিয়ে না যায়, সেজন্য পাটনা চলে গেলাম। তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। ইতি তোমার অনুদি।
বিষণ্ণ অবনীনাথ চিন্ময়ীকে নিয়ে রাজগীর থেকে সেবার ফিরে এসেছিলেন।
.
এরপর ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে হয়ে স্কুল, স্কুল থেকে কলেজ, কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটিতে যেতে লাগল। তারপর একে একে ওরা চাকরি-বাকরিতে ঢুকল। ফরেন সারভিসে ঢোকার পর বড় ছেলে অভীকের বিয়ে হল মৃদুলার সঙ্গে। বড় মেয়ের বিয়ে হল এম বি বি এস পাশ করার পর। ছোট ছেলে অঞ্জনও কমার্শিয়াল ফার্মে একজিকিউটিভ হবার পর বিয়ে করল।
ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া এবং মেয়েদের বিয়েতে কত টাকা যে অনীতা পাঠিয়েছে তার কোনো হিসেব নেই। নইলে যেভাবে এতগুলো ছেলেমেয়েকে অবনীনাথ মানুষ করেছেন তার খরচ চালানো কোনোমতেই সম্ভব ছিল না। অনীতার কাছ থেকে টাকা নিতে তিনি কুণ্ঠিত হয়েছেন কিন্তু অনীতা শোনেনি। লিখেছে, চিন্ময়ী আর অবনীনাথের ছেলেমেয়েরা কি তারও সন্তান নয়?
এইসব নানা ঘটনার মধ্যে বিরাট একটা পারিবারিক ট্র্যাজেডি ঘটে গেছে। ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেখে যেতে পারেনি চিন্ময়ী, বছর দশেক আগে ক্যান্সারে দারুণ কষ্ট পেয়ে সে মারা যায়।
যাই হোক, ছেলেমেয়েরা সবাই এখন প্রতিষ্ঠিত। বাকি ছিল ছোট মেয়ে রঞ্জনা। এক মাস আগে তার বিয়েও দিয়েছে অবনীনাথ। পৃথিবীতে সব দায়-দায়িত্ব এবং কর্তব্য তাঁর প্রায় পূর্ণ হয়েছে। শুধু বাকি রয়েছে শেষ একটি কাজ।
.
নিজের জীবনের দীর্ঘ সুগোপন এক ইতিহাস ছেলেমেয়ে পুত্রবধূ এবং জামাইদের সামনে মেলে ধরার পর অবনীনাথ বললেন কিছুই তোমাদের কাছে লুকোলাম না। হতে পারে–আমার সমন্ধে তোমাদের মনে এত কাল যে মিথটা ছিল ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। হয়তো এখন থেকে তোমরা আমাকে আগের মতো শ্রদ্ধা করতে পারবে না। তবু টুথ-টুথ-ই। তার মুখোমুখি একদিন দাঁড়াতেই হবে।
অভীক, মৃদুলা, রঞ্জনা, চৈতী–সবাই শ্বাসরুদ্ধের মতো অবনীনাথের দিকে তাকিয়ে ছিল। কেউ একটা কথাও বলল না।
অবনীনাথ আবার বললেন, আমি চাকরি থেকে রিটায়ার করেছি। অনীতাও রিটায়ার করে পরশু কলকাতায় এসেছে। একটা হোটেলে উঠেছে সে। আমি তাকে আমার এই বাড়িতে আজই নিয়ে আসব। জীবনের সব কর্তব্য শেষ করার পর আমার এই একটা কর্তব্যই বাকি রয়েছে। সমস্ত পৃথিবীর সামনে দাঁড়িয়ে এই দুঃখী মেয়েটাকে আমি স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাই। তোমরা তাকে গ্রহণ করতে পারবে কিনা জানি না। কিন্তু আমার কাজ আমাকে করতেই হবে। একটু থেমে ঘড়ি দেখে ফের বললেন, সাতটা বাজে। অনীতা আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমি যাই। অবনীনাথ উঠে পড়লেন।
.
০২.
কিছুক্ষণ পর অবনীনাথ সেন্ট্রাল ক্যালকাটার একটা হোটেলে এসে অনীতার ঘরে ঢুকলেন।
সেদিনের তরুণী অনীতা নয়, জীবনের দীর্ঘ ম্যারাথন দৌড় শেষ করে আসা প্রৌঢ়া অনীতা বিছানায় বসে ছিলেন। চুলের আধাআধি সাদা হয়ে গেছে, চোখে মোটা ফ্রেমের বাই-ফোকাল চশমা। শরীরে বয়সের ভার পড়েছে।
অবনীনাথ দেখলেন, একটা বেতের বাস্কেট আর ফোমের মাঝারি একটা সুটকেশ একধারে দাঁড় করানো রয়েছে। দেখেই টের পাওয়া যায়, সব গুছোনোই রয়েছে।
অবনীনাথ বললেন, চলো—
অনীতা যেন ভয়ে ভয়েই বললেন, অভীক, রঞ্জনা, মৃদুলা, চৈতী–ওরা সব?
ওদের সব বলেছি।
কী বললে ওরা?
কিছুই বলেনি। কেউ কিছু বলুক আর না-ই বলুক আমার যায় আসে না–অনেক দুঃখ তোমাকে দিয়েছি। এবার প্রায়শ্চিত্ত করতে দাও–অবনীনাথ সুটকেশ আর বাস্কেটটা তুলে নিয়ে বললেন, এসো
অনীতা ভীরু পায়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর অবনীনাথের পিছু পিছু বেরিয়ে এলেন।
অনীতাকে নিয়ে বাড়ির দিকে যেতে যেতে ভীষণ ভালো লাগছিল অবনীনাথের। এই পৃথিবীতে আর কদিনই বা আছেন। আয়ুর সীমার মধ্যে অনীতাকে যে মর্যাদা দিতে পারছেন, তাতেই তিনি সুখী। জীবনের অনিবার্য সমাপ্তিকে এবার তিনি দুহাত বাড়িয়ে গ্রহণ করতে পারবেন।