অনীতা উত্তর দেয়নি।
অবনীনাথ বলেছিলেন, এত ভালো থেকে তোমরা দুজনে আমাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করালে, একবার ভেবে দেখেছ।
অনীতা এবার বলেছিল, তোমার জন্য শুধু দুঃখই হয়।
সময় কেটে যেতে লাগল। এম.এ পাশ করার পর একটা দিনও অনীতা বা অবনীনাথকে বসে থাকতে হয়নি। অনীতা পূর্ণিয়ার একটা কলেজে লেকচারারের কাজ পেয়ে গেল। আর অবনীনাথ বেশ ভালো একটা চাকরি পেলেন সিভিল সাপ্লাইজে।
অনীতাকে অবশ্য কলকাতার দু-তিনটে কলেজে লেকচারারের চাকরি দেবার জন্য ডেকেছিল, কিন্তু সে পাটনার কাজটাই বেছে নিয়েছিল। কারণটা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। অবনীনাথ বলেছিলেন, তাহলে দুরেই চললে!
অনীতা বলেছিল, এতে সবারই ভালো হবে। আমি কলকাতায় থাকলে জটিলতা আর প্রবলেম বাড়বে। চাকরি পেয়েছ; বাড়ি ভাড়া করে চিন্ময়ীকে কলকাতায় নিয়ে এসো।
তোমার জীবনটা আমি নষ্ট করে দিলাম অনু। যদি কিছু মনে না করো, একটা কথা বলব।
বলল না।
কোর্ট থেকে এই বিয়েটা খারিজ করিয়ে দিচ্ছি। তুমি আর কাউকে বিয়ে করে নতুন লাইফ স্টার্ট করো।
তা আর হয় না।
কেন হয় না?
তোমার সঙ্গে আমার জীবন যেভাবেই হোক জড়িয়ে গেছে। ওটা ছেঁড়া যাবে না।
এভাবে দিন কাটবে?
কাটবে বলেই মনে হয়।
একটু চিন্তা করে বিষণ্ণ গলায় অবনীনাথ বলেছিলেন, যদি কখনও ভাবো এই বিয়েটা খারিজ করা দরকার–বোলো।
অনীতা বলেছিল, নিশ্চয়ই বলব।
অনীতা যেদিন পাটনা গেল সেদিন তাকে তুলে দেবার জন্য হাওড়া স্টেশনে গিয়েছিলেন অবনীনাথ। ট্রেন ছাড়ার আগের মুহূর্তে জানলার ধারে বসে আছে অনীতা আর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছেন অবনীনাথ।
অনীতার চোখ জলে ভরে যাচ্ছিল। সে বলেছিল, চলি–
অবনীনাথ ভাঙা গলায় বলেছিলেন, সত্যিই এত দূরে চলে যাবে, এ আমি ভাবতে পারছি না।
ট্রেনে উঠে পড়েছি। এক মিনিটের ভেতর গাড়ি ছেড়ে দেবে। আর তুমি কিনা এখনও ভাবতে পারছ না! অনীতার ঠোঁটে মলিন একটু হাসি ফুটে উঠেছিল।
জানলার কার্নিসে অনীতার একটি হাত পড়ে রয়েছে। সেই হাতের ওপর নিজের হাতটা রেখে অবনীনাথ কাঁপা গলায় বলেছিলেন, এখনও সময় আছে, নেমে এসো। তুমি চলে গেলে আমার কষ্ট হবে।
অনীতা ভাঙা গলায় বলেছিল, আমাকে দুর্বল করে দিও না। তোমাকে অনেক বেশি করে পাব বলেই তো দুরে চলে যাচ্ছি।
এই সময় গার্ডের হুইসিল বেজে উঠেছিল। সঙ্গে সঙ্গে সুবিশাল সরীসৃপের মতো দিল্লি মেল চলতে শুরু করেছিল।
যতক্ষণ সম্ভব গাড়িটার সঙ্গে সঙ্গে প্ল্যাটফর্মের ওপর দিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন অবনীনাথ। আর জানলার বাইরে মুখ বাড়িয়ে থেকেছিল অনীতা। এক সময় ট্রেনটা, হাওড়া স্টেশন পিছনে ফেলে ছোট হতে হতে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। আর প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন অবনীনাথ।
কতক্ষণ পর মনে নেই ক্লান্ত পা টেনে টেনে ফিরতে শুরু করেছিলেন তিনি। সেই যুদ্ধের সময় হাওড়া স্টেশনে গিজগিজে ভিড়। ইকুয়েশন তখন সবে আরম্ভ হয়েছে। বিহার উড়িষ্যা আসাম সেন্ট্রাল প্রভিন্স রাজস্থান–সব জায়গার মানুষ জাপানি বোমার ভয়ে কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সব সময় হাওড়ায় তখন হাট বসে আছে। তা ছাড়া রয়েছে মিলিটারি। অনবরত ট্রেন বোঝাই হয়ে গুর্খা বা জাঠ রেজিমেন্টের সোলজার কিংবা আমেরিকান আর নিগ্রো টমি হয় কলকাতায় আসছে, নইলে অন্য কোনো ডেস্টিনেশনে চলে যাচ্ছে।
এত মানুষ, এত থিকথিকে ভিড়–তবু অবনীনাথের মনে হয়েছিল চারদিক আশ্চর্য ফাঁকা। সমস্ত পৃথিবী জোড়া শূন্যতার মধ্যে সর্বস্ব খোয়ানো একটি মানুষের মতো ক্লান্ত পা টেনে টেনে বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি।
.
এরপর কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করে একদিন চিন্ময়ীকে দেশের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলেন অবনীনাথ। ক্রমে পৃথিবী কাঁপানো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ একদিন থেমে গেছে। শোনা যাচ্ছিল, ইংরেজরা এ দেশ ছেড়ে চলে যাবে। ভারতবর্ষ স্বাধীন হবে। স্বাধীন হলও একদিন। তারপর অবনীনাথের সংসারে একে একে ছেলেমেয়েরা আসতে লাগল।
সারা পৃথিবীতে আর অবনীনাথের সংসারে এত বড় বড় ঘটনা ঘটে গেল কিন্তু সেই যে অনীতা পাটনায় চলে গিয়েছিল, আর ফেরেনি। তবে প্রতি সপ্তাহেই চিঠি লিখত সে। অবনীনাথকে না, চিন্ময়ীকে। ছেলেমেয়েদের খবর নিত সে, অবনীনাথের খবর নিত। বড় বোনের মতো চিন্ময়ীকে অনেকরকম পরামর্শ এবং উপদেশ দিত।
অবনীনাথ লুকিয়ে দু-একবার অনীতাকে চিঠি দিয়েছেন। উত্তর পাওয়া যায়নি। চিন্ময়ীর সেবাযত্নের তুলনা ছিল না। কীসে অবনীনাথের সুখ কীসে আরাম সব দিকে তার হাজার চোখ মেলা ছিল। তবু বুকের ভেতর কোথায় যেন খানিকটা জায়গা ফাঁকা থেকেই গিয়েছিল। অফিসের কাজে বাইরে যেতে হবে এই বলে চিন্ময়ীকে লুকিয়ে দু-একবার পাটনায় গিয়ে অনীতার সঙ্গে দেখা করেছেন অবনীনাথ।
অনীতা বলেছে, তুমি এভাবে এসে আমাকে লোভ দেখিও না।
কলকাতায় ফেরার পর চিন্ময়ী বলেছে, তুমি পাটনায় অনুদির কাছে গিয়েছিলে?
অবনীনাথ চমকে উঠেছেন, কে বললে?
অনুদি চিঠি লিখেছে।
অবনীনাথ চিন্ময়ীর দিকে তাকাতে পারেননি।
চিন্ময়ী বলেছে, অনুদির কাছে নিশ্চয়ই যাবে। তবে আমাকে লুকিয়ে না। তুমি তো অন্যায় কিছু করোনি।
অবনীনাথের মাথা আরও নীচু হয়ে যেত।
মনে পড়ে জীবনে একবারই মাত্র অনীতার সঙ্গে চিন্ময়ীর দেখা হয়েছে। সেটা বোধ হয় নাইন্টিন ফিফটি-টিফটি হবে। মাকে বাড়ি থেকে আনিয়ে ছেলেমেয়েদের ভার তাঁর ওপর দিয়ে চিন্ময়ীকে সঙ্গে করে পুজোর ছুটিতে রাজগীর গিয়েছিলেন অবনীনাথ। অনীতাও তার কলেজেরে মেয়েদের নিয়ে ওখানে এক্সকার্শানে এসেছিল। আরও কয়েকজন অধ্যাপিকাও ছিলেন সেই দলে।