চিন্ময়ী তাঁর মুখে হাত রেখে আস্তে করে বলেছিল, এমন কথা বলতে নেই। তুমি আমার চেয়ে অনেক ভালো, অনেক বড়। অবনীনাথকে সেই প্রথম চিন্ময়ীর তুমি বলা।
অনেকটা সময় স্ত্রীকে বুকের ভেতর ধরে রেখে অবনীনাথ এক সময় বলেছিলেন, অনীতার সঙ্গে আমার বিয়ের কথাটা বাড়ির কেউ জানে না।
ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেছিল চিন্ময়ী। সে বলেছে, এটা গোপনই থাকবে। অন্তত আমার মুখ থেকে কেউ শুনতে পাবে না। লোকের কাছে তোমার মাথা নীচু হয়ে যাবে, তাই কি আমি করতে পারি!
এই মেয়েটাকে বেশি করে ব্যাখা করে কিছুই বলতে হয় না। একটু ইঙ্গিত পেলেই সে সব ধরে নিতে পারে। পূর্ণিমা পক্ষের অঢেল মায়াবী জ্যোৎস্নার মতো চিন্ময়ী তাঁর জীবনে এসেছে। একে নিয়ে কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না অবনীনাথ। প্রাথমিক আবেগ কিছুটা কমে এলে তাঁর মনে হয়েছিল, এভাবে চিন্ময়ীকে বুকের ভেতর টেনে আনা ঠিক হয়নি। তাকে বুঝতে না দিয়ে আস্তে আস্তে বিছানার একধারে সরে গিয়েছিলেন অবনীনাথ। আবছা গলায় এবার বলেছিলেন, আমাকে কলকাতায় চলে যেতে হবে।
চিন্ময়ী বলেছিল, নিশ্চয়ই যাবেন, পরীক্ষা সামনে।
কলকাতায় গেলে অনীতার সঙ্গে আমার রোজ দেখা হবে।
দেখা তো হবেই।
অবনীনাথ বলেছিলেন, তুমি একটা মেয়ে তো!
চিন্ময়ী হেসে ফেলেছিল, আমার তো সেইরকমই ধারণা। লোকেও সেই কথাই বলে। মেয়ে না হলে একজন পুরুষের সঙ্গে বিয়েটা হল কী করে?
অবনীনাথ বিছানায় উঠে বসেছিলেন। বলেছিলেন, ঠাট্টা নয়। নিজের কথা একবার ভেবে দেখেছ?
দেখেছি। তুমি কলকাতায় থাকবে, আমি এই গ্রামের বাড়িতে। যদি এখানে কখনও-সখনও আসো, দেখতে পাব। তখন ভীষণ ভালো লাগবে।
তোমাকে নিয়ে পারা যায় না। অনীতা যদি তার দাবি না ছাড়ে, আমাকে আসতে না দ্যায়, তাহলে তোমার কী হবে–সেটাই জানতে চাইছি।
কোনো মেয়েই তার স্বামীকে ছাড়তে চায় না। অনীতাদিই বা ছাড়বেন কেন? তাঁর সঙ্গে তোমার আগে বিয়ে হয়েছে। তাঁর দাবি আমার চাইতে বেশি। তিনি যদি তোমাকে আসতে দেন, দেখা হবে। নইলে জীবন একভাবে-না-একভাবে এখানে কেটে যাবেই।
অবনীনাথ গভীর দুঃখের গলায় বলেছিলেন, চিরকাল তোমার কাছে আমি অপরাধী হয়েই থাকব।
.
পরের দিন কলকাতায় চলে এসেছিলেন অবনীনাথ। ভোরের ট্রেনে আসতে পারেননি, দুপুরের ট্রেন ধরে পৌঁছেছিলেন রাত্তিরে। ফলে সেদিন আর ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া হয়নি। তার পরের দিন যেতেই উৎকণ্ঠিতের মতো অনীতা জিগ্যেস করেছিল, কী হয়েছিল বাড়িতে? খারাপ কিছু?
মুখ তুলে তাকাতে পারছিলেন না অবনীনাথ। শ্বাসকষ্টের মতো একটা যন্ত্রণা তাঁর বুকের ভেতর থেকে উঠে এসে সারা শরীরে যেন ছড়িয়ে পড়ছিল।
অনীতা জিগ্যেস করেছিল, কী হয়েছে বলছ না যে?
বলতে অনেকক্ষণ সময় লাগবে। তোমার অফ পিরিয়ড কখন?
একটায়।
তখন কোথাও গিয়ে বসে বলতে হবে।
ঠিক একটার সময় অনীতাকে নিয়ে কলেজ স্কোয়ারের এক কোণে গিয়ে মুখোমুখি বসে ছিলেন অবনীনাথ। কলকাতার সেই সেকেন্ড গ্রেট ওয়ারের সময় নিগ্রো আর আমেরিকান টমিতে গিজ গিজ করছে। এয়ার রেইডের ভয়ে প্রত্যেকটা পার্কে লম্বা লম্বা ট্রেঞ্চ খোঁড়া। মিলিটারির জন্য কোথাও বসার উপায় নেই। সেই তুলনায় ইউনিভার্সিটির উলটোদিকে সেই পার্কটা ছিল অনেক নিরিবিলি।
অনীতা বলেছিল, এবার শুরু করো।
অবনীনাথ বলেছিলেন, দেশে গিয়ে আমি তোমার সর্বনাশ করে এসেছি অনু।
অনীতা চমকে উঠেছিল। তারপর বিমূঢ়ের মতো বলেছে, তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।
সব শুনলেই পারবে। এরপর অবনীনাথ চিন্ময়ীর সঙ্গে তাঁর বিয়ের ব্যাপারটা বলে গিয়েছিলেন। চিন্ময়ীর সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে তার কিছুই বাদ দেননি।
শোনার পর দুই হাঁটুতে মুখ গুঁজে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল অনীতা।
অবনীনাথ বলেছিলেন, এখন আমি কী করব, তুমিই বলে দাও।
অনীতা উত্তর দেয়নি।
অবনীনাথ আবার বলেছিলেন, ভাবছি তোমার বাবাকে সব জানাব। তারপর কোর্টে গিয়ে তোমার সঙ্গে আমার বিয়েটা যাতে খারিজ হয়ে যায় তার জন্য আপিল করব। কিংবা তোমরা যা শাস্তি দেবে তা মাথা পেতে নিতে আমি রাজি।
অনীতা কেঁদেই যাচ্ছিল, কেঁদেই যাচ্ছিল। কান্নাটা একটু কমে এলে বলেছে, বাবা বা আর কাউকে তোমার এই বিয়ের ব্যাপারটা জানাবার দরকার নেই। কোর্টেও তোমাকে যেতে হবে না। যা হয়ে গেছে সেটাকে ডিসটার্ব করে লাভ নেই। তাতে প্রবলেম অনেক বেড়ে যাবে।
কিন্তু
এম.এ পর্যন্ত এখন চুপচাপ থাকো। তারপর চিন্ময়ীর কাছে চলে যেও।
চিন্ময়ী তো তোমার কাছেই আসতে বলেছে।
সেটা তার মহানুভবতা। একটা মেয়ের কাছে এমন মহত্ত্ব ভাবা যায় না। তাকে আমার শ্রদ্ধা জানিও।
একটু চুপ করে থেকে অবনীনাথ বলেছিলেন, তোমার কী হবে?
অনীতা চোখ-টোখ মুছে খুব শান্ত গলায় বলেছিল, দেখো, আমি খানিকটা লেখাপড়া জানি। ইউনিভার্সিটির লাস্ট ডিগ্রিটা কিছুদিনের মধ্যেই আমার হাতে এসে যাবে। আর যা সময় আসছে তাতে ছেলেদের তো নিশ্চয়ই, মেয়েদের চাকরি-বাকরির স্কোপও অনেক বেড়ে যাবে। এম.এ-র ডিগ্রিটা হাতে থাকলে একটা কিছু ব্যবস্থা করে ফেলতে পারবই। কিন্তু চিন্ময়ীর তো কলেজ-ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি নেই। বড় ভালো মেয়ে ও; তুমি না দেখলে ওর জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে।
অবনীনাথের বুকের অসংখ্য স্তর ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এসেছিল। তিনি আস্তে আস্তে বলেছিলেন, তোমরা দুজনেই বড় ভালো। কেন তোমরা স্বার্থপর হিংসুক হলে না?