এই গ্রাম্য মেয়েটির কাছে এ জাতীয় কথা প্রত্যাশা করেননি অবনীনাথ। তিনি যতটা অবাক হয়েছিলেন তার চাইতে অনেক অনেক বেশি মুগ্ধ।
চিন্ময়ী বলে যাচ্ছিল, বিয়েটা যখন হয়েই গেছে তখন দয়া করে আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না; আপনাদের বাড়ির এক কোণে একটু থাকতে দেবেন। আমি এমন কিছু করব না, বলব না, যাতে আপনাদের অমর্যাদা হয়।
নিজের মুখেই চিন্ময়ী বলেছে সে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছে। কিন্তু যেভাবে সে কথা বলছিল তাতে মনেই হয়নি তার লেখাপড়া এত কম। মার্জিত, শিক্ষিত এবং বুদ্ধিমতী মনে হচ্ছিল তাকে। সেই সঙ্গে প্রবল অনুভূতিসম্পন্নও।
চিন্মীয় আবার বলেছিল, বাবাকে আমি অনেক বারণ করেছিলাম। বাবা শুনলেন না। তাঁকে দোষ দিচ্ছি না; সব বাবাই নিজের মেয়েকে সুখী দেখতে চান। কিন্তু টাকা দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকার আকাশপাতাল পার্থক্য ঘোচানো যায় না। যাক গে, আমি যে এখন থেকে আপনাদের বাড়িতে থাকব সেটা ইচ্ছা না হলে মনে রাখার দরকার নেই। আপনার যেভাবে খুশি চলবেন, আমি বাঁধা দেব না।
চিন্ময়ীর জন্য হঠাৎ খুব মমতা বোধ করেছিলেন অবনীনাথ। গম্ভীর গলায় বলেছিলেন, তোমার মতো মেয়ে আগে কখনও দেখিনি।
চিন্ময়ী উত্তর দেয়নি।
অবনীনাথের ইচ্ছা হয়েছিল, নতুন এই স্ত্রীকে হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নেন। তৎক্ষণাৎ অনীতার মুখ তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। বুকের গভীর থেকে নিশ্বাস ফেলে বলেছেন, অনেক রাত হয়েছে, শুয়ে পড়ো।
বাধ্য মেয়ের মতো বিছানায় গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়েছে চিন্ময়ী।
ফুলশয্যার পর দিন তিনেক বাড়িতে ছিলেন অবনীনাথ। এর মধ্যে চিন্ময়ীকে যত দেখেছেন ততই মুগ্ধ হয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে চিন্ময়ীর শ্রদ্ধা, সংসার সম্পর্কে কর্তব্যবোধ, মা-বাবাকে সেবা, ছোট ছোট দেওর এবং ননদদের যত্ন–তার আচরণে বা কথাবার্তায় কোথাও এতটুকু ত্রুটি নেই। বোঝাই যেত না–সে লক্ষপতি মাখন গাঙ্গুলির বাড়ি থেকে হতদরিদ্রের ঘরে এসে পড়েছে। তার বাবার অনুগ্রহই যে অবনীনাথরা ছাদের নীচে বাস করতে পারছে, চিন্ময়ীর আচারে ব্যবহারে তা এক মুহূর্তের জন্যও ফুটে উঠত না।
চিন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে সর্বক্ষণ অবনীনাথের মনে হত, এই সরল নিষ্পাপ কর্তব্যপরায়ণ মেয়েটাকে তিনি অনবরত ঠকিয়ে যাচ্ছেন। বড় ভালো চিন্ময়ী, বড় বেশি রকমের ভালো। তাকে প্রতারণা করার অধিকার তাঁর নেই।
রাত্তিরে পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে নতুন এই স্ত্রীকে ছুঁতে ইচ্ছা করত অবনীনাথের। কতবার হাত বাড়িয়ে তিনি যে গুটিয়ে নিয়েছেন, ঠিক নেই। চিন্ময়ীকে ছুঁতে গেলেই অনীতাকে মনে পড়ে যায়। জীবনের এক মেরুতে রয়েছে অনীতা, আরেক মেরুতে চিন্ময়ী। অবনীনাথের সমস্ত অস্তিত্ব উদভ্রান্তের মতো দুই প্রান্তে যেন ছোটাছুটি করতে শুরু করেছিল। দারুণ এক পাপবোধ তাঁকে অস্থির করে তুলেছিল। প্রায়ই ভাবতেন, অনীতার কথা গোপন করে রাখা ঠিক হবে না। চিন্ময়ীকে সব কিছু খুলে বলবেন। কিন্তু বলতে গেলেই অদৃশ্য হাতে কেউ যেন মুখ চেপে ধরত।
শেষ পর্যন্ত কলকাতায় ফেরার আগের দিন রাত্রে অবনীনাথ মনস্থির করে ফেলেছিলন। বলেছিলেন, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে চিন্ময়ী–
চিন্ময়ী তাঁর দিকে পরিপূর্ণ চোখে তাকিয়ে ছিল, বলুন
তোমাকে এমন কিছু বলব যাতে আমাকে সারাজীবন তুমি ঘৃণা করবে। কিন্তু না বলে উপায় নেই; আমি ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি।
আপনি বলুন। কথা দিচ্ছি, সব শোনার পরও আপনাকে আমি চিরদিন শ্রদ্ধা করেই যাব।
সব শোনার পর তোমার শ্রদ্ধা করার ইচ্ছাটা থাকবে না।
নিশ্চয়ই থাকবে। আপনি দেখে নেবেন।
এই গেঁয়ো মেয়েটা, ক্বচিৎ কখনো যে রামপুরহাটের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরে গেছে, –কোত্থেকে মনের এত অলৌকিক জোর পায়? অবনীনাথ বলেছিলেন, যা বলব তাতে তোমার ভীষণ দুঃখ হবে। সে দুঃখ সহ্য করতে পারবে তো?
চিন্ময়ী বলেছিল, আমি সব কিছুর জন্য প্রস্তুত।
এরপর অবনীনাথ অনীতার সঙ্গে তার আলাপ থেকে শুরু করে বিয়ে পর্যন্ত সব কিছু বলে দিয়েছিলেন।
অনেকক্ষণ চুপচাপ। তারপর অবনীনাথ ফের বলেছিলেন, আশা করি বুঝতেই পারছ, অনীতাকে বিয়ে না করে আমার উপায় ছিল না। নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার?
বিষণ্ণ ভারী গলায় চিন্ময়ী বলেছিল, হ্যাঁ হচ্ছে। কোনো মেয়েই তার স্বামীর ভাগ অন্যকে দিতে চায় না।
আমার সম্বন্ধে ধারণাটা এবার বদলে ফেলো চিন্ময়ী।
পারব না। আপনি অন্যায় বা পাপ কিছু করেননি। অনীতাদিকে বিয়ে করে তাঁকে বাঁচিয়েছেন। আমাকে বিয়ে করে বাঁচিয়েছেন নিজের মা-বাবা ভাই-বোনকে। আপনার ওপর আমার শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে গেল।
কিন্তু তোমার তোমার কী হবে?
আমি তো আপনাকে আগেই বলে দিয়েছি, আমার কোনো দাবি নেই।
হঠাৎ কী হয়ে গিয়েছিল অবনীনাথের, ইচ্ছা-অনিচ্ছা কোনোটাই তাঁর নিজের আয়ত্তে ছিল না। প্রগাঢ় আবেগে চিন্মীয়কে দুহাতে বুকের গভীরে টেনে নিয়ে বলেছিলেন, তুমি কেন এত কথা শুনে যদি খেপে উঠতে, আমাকে ঘেন্না করতে, তাহলে আমার একটা সান্ত্বনা ছিল। ভাবতে পারতাম, যে অন্যায় আমি করে ফেলেছি তার কিছুটা প্রাপ্য পেয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এত ভালো থেকে তুমি আমার পাপের কষ্টটা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছ। তুমি আমাকে একটু ঘেন্না করো চিন্ময়ী, একটু ঘেন্না করো।