এরপর লজ্জায় ব্যারাকপুরে আর যেতেন না অবনীনাথ। অনীতা ইউনিভার্সিটিতে আসত; সেখানেই তার সঙ্গে দেখা হত।
কোর্টরুমের সঙ্গোপন বিয়ের পর মনের দিকটা রাতারাতি বদলে গিয়েছিল অবনীনাথের। তখন অনীতাকে সর্বক্ষণ কাছে পেতে ইচ্ছা করত; অনীতারও সেই একই ইচ্ছা। কিন্তু কোনো উপায় ছিল না। এম. এ-র রেজাল্ট পর্যন্ত তাঁদের অপেক্ষা করতেই হবে। তারপর বিয়ের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে কোন বিস্ফোরণের মুখে পড়তে হবে, কে জানে!
মাসখানেক কাটার পর আচমকা বাড়ি থেকে একটা টেলিগ্রাম এল। বাবা তাঁকে যেতে লিখেছেন।
মানুষের জীবন যে কী মারাত্মক এবং জটিল এক নাটক, বাড়ি গিয়ে টের পাওয়া গিয়েছিল। বাবা আর মা অবনীনাথকে একটা ঘরে নিয়ে যা জানিয়েছিলেন তা এই রকম। শেষ যে তিরিশ বিঘা জমি এবং বাড়িটা কোনোক্রমে টিকে ছিল, কিছু দিন হল বাঁধা পড়েছে। সুদে-আসলে অঙ্কটা এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যে এই সম্পত্তি ছাড়ানো অসম্ভব। যার কাছে এইসব জমিজমা বাঁধা রয়েছে পাশের গ্রামের সেই উঠতি ধনী মাখনলাল গাঙ্গুলি দুটি শর্ত দিয়েছে। পনেরো দিনের মধ্যে টাকা শোধ না করলে বিষয় সম্পত্তি ক্রোক করে নেবে। তাতে ছেলেমেয়েদের হাত ধরে রাস্তায় গিয়ে বসতে হবে বাবাকে। মাখন গাঙ্গুলির দ্বিতীয় শর্ত, অবনীনাথ তাঁর মেয়ে চিন্ময়ীকে যদি বিয়ে করেন, যৌতুক হিসেবে বাড়ি এবং জমিজমার দলিলপত্র ফেরত দেবে। এখন কোনটা বেছে নিলে সুবিধা হয় সেটা বাবার অভিরুচি। তবে এর মাঝামাঝি কোনো ব্যবস্থা নেই। এখন এই পরিবারের সব কিছু নির্ভর করছে অবনীনাথের ওপর। অবনীনাথ যদি এ বিয়েতে রাজি হন, সংসারটা বেঁচে যাবে; নইলে ভেসে যেতে হবে।
শুনতে শুনতে একটা ধারালো ফলা যেন আমূল অবনীনাথের মাথার ভেতর ঢুকে যাচ্ছিল। রক্তাক্ত কোনও জন্তুর মতো তিনি চিৎকার করে উঠেছিলেন, কিন্তু গলার ভেতর থেকে অবরুদ্ধ গোঙানির মতো একটা শব্দ বেরিয়ে এসেছিল। তিনি বলতে চেয়েছিলেন, এ হয় না, হতে পারে না। আমি বিবাহিত; অনীতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না। কিন্তু তাঁর কথা কেউ বোঝেনি।
এরপর কটা দিন কীভাবে যে কেটে গিয়েছিল তিনিই জানেন। একবার ভেবেছিলেন কলকাতায় পালিয়ে যাবেন কিন্তু অদৃশ্য এক ফাঁদে তিনি যেন আটকে গিয়েছিলেন। অবনীনাথের ওপর তাঁর নিজের কোনো ইচ্ছা বা অনিচ্ছা কাজ করছিল না। আশ্চর্য এক ঘোরের মধ্যেই যেন মাখন গাঙ্গুলির মেয়ে চিন্ময়ীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।
এ বিয়েতে কলকাতা থেকে মামা-মামি এসেছিলেন। অবনীনাথ তাঁদের হাত ধরে অনুনয়ের গলায় বলেছিলেন, বিয়ের কথা যেন তাঁরা কলকাতায় কাউকে না বলেন। বিশেষ করে অনীতা বা তার মা-বাবাকে। মামা-মামি কথা দিয়েছিলেন, বলবেন না। ওঁদের হয়তো ধারণা হয়েছিল, পড়াশোনার মধ্যেই বিয়ে করতে হচ্ছে বলে অবনীনাথ হয়তো লজ্জা পাচ্ছেন। সেটাই স্বাভাবিক।
বিয়ের আগের দিন মা বলেছিলেন, সংসারের জন্যে তোকে বলি দিলাম। তোর দিকটা একবারও আমরা দেখলাম না। স্বার্থপর মাকে ক্ষমা করিস বাবা। তাঁর দুচোখ দিয়ে অবিরল জল ঝরে যাচ্ছিল। অবনীনাথ উত্তর দেননি।
বিয়ের পর ফুলশয্যার রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়া মিটে গেলে দূর সম্পর্কের বউদি, বোন আর মাসি-পিসিরা অবনীনাথকে তাঁর ঘরে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিলেন।
সতেরো বছরের স্ত্রী চিন্ময়ী গয়না এবং লাল বেনারসীতে শরীর মুড়ে ফুল দিয়ে সাজানো নতুন মকরমুখী খাটের একধারে নত মুখে বসে ছিল। অবনীনাথ ঘরের দরজায় খিল আটকে সোজা তাঁর কাছে যাননি। জানলার কাছে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন। সেটা পূর্ণিমাপক্ষ। আকাশে রুপোর থালার মতো গোল চাঁদ উঠেছে। মাঠ-ঘাট শস্যক্ষেত্র অলীক কোনো স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল।
কিন্তু পৃথিবীর কোনো দৃশ্যবলীই যেন চোখে পড়ছিল না অবনীনাথের। ব্যারাকপুরের এক দুঃখী অসহায় মেয়ের মুখ আকাশের ক্যানভাসে বার বার ফুটে উঠছিল। তাঁর কাছে গিয়ে কী যে বলবেন, কেমন করে তাঁকে মুখ দেখাবেন, ভাবতে পারছিলেন না।
কত ক্ষণ জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন, রাত কতটা গম্ভীর হয়েছিল খেয়াল ছিল না অবনীনাথের। হঠাৎ মৃদু গলা কানে আসতে চমকে উঠেছিলেন।
শুনুন–
ঘাড় ফেরাতেই চোখে পড়েছিল–চিন্ময়ী। কখন যে খাটের কোণ থেকে উঠে এসেছে, টের পাননি অবনীনাথ।
চিন্ময়ী তাঁর অচেনা নয়। পাশের গ্রামের মেয়ে, ছেলেবেলায় অনেকবার দেখেছেন। কিন্তু বড় হবার পর দেখা প্রায় হতই না; বিশেষ করে কলকাতায় এম, এ পড়তে যাবার পর।
চিন্ময়ী কিন্তু আশ্চর্য রূপসি। টকটকে লাল বেনারসী, গা-ভর্তি গয়না আর শাঁখা-সিঁদুরে তাকে কোনো মায়াকাননের ফুলের মতো দেখাচ্ছিল। অবনীনাথ তার দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারেননি। বলেছিলেন, কিছু বলবে?
চোখ নামিয়ে চিন্ময়ী বলেছিল, হ্যাঁ।
সেই নাইন্টিন ফটিওয়ানে অর্থাৎ এখন থেকে আটত্রিশ বছর আগে কোনো মেয়ের পক্ষে ফুলশয্যার রাত্তিরে স্বামীর সঙ্গে নিজের থেকে কথা বলতে আসা খুবই অভাবনীয়। সাধারণত এমন একটি রাত্তিরে স্বামীরাই এগিয়ে গিয়ে স্ত্রীর সংকচ লজ্জা ভাঙাত। এখানে উলটো ব্যাপার ঘটেছিল। কয়েক পলক অবাক তাকিয়ে থেকে অবনীনাথ বলেছিলেন, বেশ তো, বলো–
মুখ নীচু করেই চিন্ময়ী আস্তে আস্তে বলেছিল, আমি ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছি। আপনি এম, এ পড়েন। ছাত্র হিসেবে আমাদের এখানে কত নাম আপনার। আমি কোনো দিক থেকেই আপনার যোগ্য না। বাবা টাকার জোরে এই বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমি জানি, আমাকে আপনার ভালো লাগতে পারে না।