ওই বিয়ের ব্যাপারটা তো সাজানো, সময় কাটাবার জন্যে টেম্পোরারি একটা অ্যারেঞ্জমেন্ট। অনীতা আমাকে সব বলেছে।
অনিমেষ চমকে উঠেছিলেন, তুমি তাহলে সব জানো।
অবনীনাথ উত্তর দেননি।
অনিমেষ এবার প্রায় ভেঙে পড়েছিলেন, ওইরকম একটা ডিবচ মাতাল বদমাস ছেলের হাতে কী করে নিজের মেয়েকে তুলে দিই, তুমিই বলো। প্রথমেই যদি না বলি, নানারকম অশান্তি হবে, তাই এই ব্যবস্থাটা নিয়েছি। আচ্ছা, পরে তোমার সঙ্গে দেখা হবে।
বুঝতেই পারছেন, আপনাদের বাড়ি আমার পক্ষে যাওয়া ঠিক হবে না। যদি আমাকে দরকার হয়, তাহলে কোথায় দেখা করব, বলবেন। আমি নিজে গিয়ে দেখা করব। শুধু দয়া করে আমার মামার ওখানে গিয়ে এসব নিয়ে ডিসকাস করবেন না।
ঠিক আছে।
পরের দিন ইউনিভার্সিটিতে এসে অবনীনাথের সঙ্গে দেখা করেছিলেন অনিমেষ। আবার কলেজ স্কোয়ার গিয়েছিলেন দুজনে। অনিমেষ বলেছিলেন, কাল ব্যারাকপুর গিয়েছিলাম। চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা হল। উল্লুকটাকে মেরে তুমি ঠিক কাজই করেছ। খানিকক্ষণ চিন্তা করে ফের বলেছিলেন, অনুটাকে কী করে বাঁচানো যায় বুঝতে পারছি না। নবকুমারের কথা আমি ভাবছি না। এম. এ টা পাশ করর পর মেয়েটা চাকরি-টাকরি নিয়ে উইমেন্স হোস্টেলে চলে যাবে, তা-ও একরকম ঠিক করা আছে। কিন্তু সেটা তো কমপ্লিট সলিউশান না। হাজার হোক, মেয়ে তো; তার নিজস্ব ঘর-সংসার-স্বামী দরকার। তারপর হঠাৎই গলা নামিয়ে বলেছিলেন, চক্রবর্তী একটা সাজেশান দিয়েছে, কিন্তু তোমাকে বলতে সাহস হয় না।
কী সাজেশান?
তুমি নাকি অনুর সম্বন্ধে খুব ভাবো। কীভাবে ওকে বাঁচানো যায়, সে সম্বন্ধে আরেকটু ভালো করে ভেবো।
ঠিক এই কথাটাই যে ডাক্তার চক্রবর্তী বলেছেন, সেটা আগেই আন্দাজ করে নিয়েছিলেন অবনীনাথ। বলেছিলেন, আপনার কথা আমার মনে থাকবে।
এরপর দুটো দিন গভীর অন্যমনস্কতার মধ্যে কেটে গেছে অবনীনাথের। শেষ পর্যন্ত নিজের মতো করে তিনি স্থির করে ফেলেছিলেন, অনীতাকে বাঁচাতে হলে বিয়েটা করতেই হবে। তৃতীয় দিন দুপুরে অনিমেষের অফিসে গিয়ে তিনি নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছিলেন। অনিমেষের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। বলেছিলেন, তুমি আমাকে বাঁচালে বাবা। কিন্তু
কী?
এর মধ্যে একটা ব্যাপার আছে–বলতে বলতে কণ্ঠস্বর বিষণ্ণ হয়ে উঠেছিল অনিমেষের।
অবনীনাথ দ্বিধান্বিতের মতো জিগ্যেস করেছিলেন, কী ব্যাপার?
উত্তর না দিয়ে অনিমেষ বলেছিলেন, আচ্ছা, এখন তোমার সময় আছে?
অবনীনাথ বলেছিলেন, আছে। কেন?
আমার সঙ্গে একবার ব্যারাকপুর যেতে হবে। ওখানে বসেই কিছু কথা বলতে চাই। চক্রবর্তীও থাকবে।
ব্যারাকপুরে এসে ডাক্তার চক্রবর্তী, তাঁর স্ত্রী, অনীতা, অবনীনাথ আর অনিমেষ–এই পাঁচজন ড্রইংরুমে বসেছিলেন। খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর অনিমেষ বলেছিলেন, তুমি অনীকে বিয়ে করতে চেয়েছ এর চাইতে বড় রিলিফ আমার কাছে কিছু নেই। কিন্তু তুমি কি জানো, আমরা ক্রিশ্চান? অনুকে বিয়ে করলে তোমাকে ধর্মত্যাগ করে ক্রিশ্চান হতে হবে।
প্রায় দুবছরের মতো অনিমেষদের দেখছেন অবনীনাথ। ওদের মধ্যে শাঁখা-সিরের চল আছে। অনীতাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত, অতুলপ্রসাদী, এমনকী রামপ্রসাদের গান পর্যন্ত গাইতে দেখেছেন। এমন কোনো লক্ষণ এতদিন চোখে পড়েনি যা দেখে শনাক্ত করা যায় ওঁরা হিন্দু নন।
আচমকা মাথার ওপর আকাশ ধসে পড়ার মতো একটা অনুভূতি হয়েছিল অবনীনাথের, পায়ের তলার মেঝে পৃথিবীর দীর্ঘতম ভূমিকম্পে যেন ঢেউয়ের মতো দুলে যাচ্ছিল। চোখের সামনে সিনেমার স্লাইডে একের পর এক তান্ত্রিক বাবার মুখ, মায়ের মুখ এবং ভাইবোনেদের মুখ ক্রমাগত ফুটে ফুটে উঠছিল। আজন্ম যে ধর্ম এবং সংস্কারের মধ্যে তিনি বড় হয়ে উঠেছেন, তা ছাড়তে হবে। কিন্তু অনু–অনীতা—
তাঁর ভাবনার মধ্যেই অনীতা বলে উঠেছিল, না, আমার জন্যে কাউকে ধর্ম ছাড়তে হবে না।
অনিমেষ বলেছিলেন, কিন্তু
কোনো কিন্তু না। অবনীর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত বাবা। আমাকে বিয়ে করতে চেয়ে ও কত বড় ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে, ভাবতে পারো? আমি ওর বাড়ির কথা সব শুনেছি। এ বিয়ে হলে চিরকালের জন্য বাড়ির সঙ্গে ওর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে। তার ওপর ধর্ম বদলিয়ে ওর ক্ষতি করা ঠিক না।
ডাক্তার চক্রবর্তী এই সময় জানিয়েছিলেন, নিজের নিজের ধর্মের মধ্যে থেকেও কোর্টে গিয়ে সিভিল ম্যারেজ সম্ভব এবং অনীতা আর অবনীনাথের ব্যাপারে সেটাই বাঞ্ছনীয়।
আরও কিছুক্ষণ আলোচনার পর সিভিল ম্যারেজেরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। এবং এটাও ঠিক করা হল, বিয়ের ব্যাপারটা আপাতত এই কয়েকজন ছাড়া আর কাউকে জানানো হবে না। বিয়ের পর অনীতা ব্যারাকপুরেই থাকবে; এখান থেকেই ইউনিভার্সিটিতে যাতায়াত করবে। বিয়ে হয়ে গেছে বলে নবকুমারকে বিন্দুমাত্র ঘাঁটানো হবে না। শুধু তাকে জানিয়ে দিতে হবে ব্যারাকপুরে এসে এর পর অনীতা বা ডাক্তার চক্রবর্তীদের বিরক্ত করলে বিয়ে ভেঙে যাবে। নবকুমারকে জানানোর দায়িত্ব দেওয়া হল অনিমেষকে। মেয়ের বিয়ে যখন ঠিক হয়ে গেছে তখন নিজের লড়বড়ে মেরুদণ্ডে অনেকখানি জোর পেয়েছেন অনিমেষ। বোঝা যাচ্ছিল, নবকুমারকে তিনি ওই কথাগুলো মুখের ওপর বলে দিতে পারবেন।
এক সপ্তাহের মধ্যেই কোর্টরুমে অনীতার সঙ্গে অবনীনাথের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল গোপনে। চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে এমন নিরুৎসব বিয়ে কোনও মেয়ের জীবনেই বোধ হয় ঘটে না। অবশ্য বাড়িতে ডাক্তার চক্রবর্তীরা সেদিন খুব খাইয়েছিলেন। পরের দিন স্বাভাবিক যেভাবে মামাদের বাড়ি ফেরেন সেভাবেই ফিরে এসেছিলেন অবনীনাথ। তাঁর জীবনে যে এত বিশাল একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে সেটা মামারা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি।