রক্তপাতের জন্য ব্র্যান্ডি এবং প্রচুর মিষ্টি-টিষ্টি খাইয়ে ব্ল্যাকআউটের রাত্তিরে অবনীনাথকে লাস্ট ট্রেনে তুলে দিতে গিয়েছিলেন ডাক্তার চক্রবর্তী। ট্রেন আসার আগে অন্ধকার ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, এবার সেই কথাটা বলা যেতে পারে। তুমি ছোকরা মনে মনে অনুকে ভালোবাসো। নইলে এমন একটা কাণ্ড বাধাতে পারতে না–
অবনীনাথ চমকে উঠেছিলেন, এ আপনি কী বলছেন? ওই লোকটা খিস্তি দিচ্ছিল, আপনার সঙ্গে ইতরামো করছিল। তাই
আমার ব্যাপারটা উপলক্ষ্য। বলে একটু চুপ করে থেকেছেন ডাক্তার চক্রবর্তী। তারপর কী ভেবে আবার বলেছেন, অনুর কাছে শুনেছি তুমি তার সত্যিকারের বন্ধু-রিয়েল ফ্রেন্ড ইন নিড। দেখো ছোকরা, আমি ওল্ড স্কুলের লোক; নাইন্টিনথ সেঞ্চুরিতে জন্মেছি, আমার ধ্যানধারণা–সব সেকালের মতো। আমি বাপু একজন যুবক-যুবতীর মধ্যে নিরামিষ বন্ধুত্বের রিলেশানে বিশ্বাস করি না। দেয়ার মাস্ট বি সামথিং এলস। এই যে তুমি ওই বজ্জাত ছোকরাটাকে বেধড়ক ঠ্যাঙালে তার পেছনে রয়েছে খুব সূক্ষ্ম একটা জেলাসি বা রাইভ্যালরি। এনিওয়ে, আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি।
অন্ধকারে কেউ কাউকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন না। পেলে ডাক্তার চক্রবর্তী বুঝতে পারতেন, অবনীনাথের মুখ লাল হয়ে উঠেছে। বিব্রতভাবে তিনি বলেছিলেন, আপনি যা বলছেন তা ঠিক না।
হানড্রেড পারসেন্ট ঠিক। সাইকোলজিটা আমি একটু-আধটু বুঝি হে ছোকরা, এই ইনসিডেন্টটা থেকে আমি কোন ধারায় পৌঁছুলাম জানো?
উত্তর না দিয়ে তাকিয়েছিলেন অবনীনাথ।
ডাক্তার চক্রবর্তী বলেছিলেন, অনুর বাবার পক্ষে মেয়েকে সেভ করা সম্ভব না কিন্তু তুমি পারবে। সে গাটস আর সাহস তোমার আছে। কীভাবে কী করলে মেয়েটা পার্মানেন্টলি বেঁচে যায় একটু ভেবে দেখো তো।
অবনীনাথ কিছু বলার আগেই ট্রেন এসে গিয়েছিল।
বাড়ি ফিরে সারারাত ঘুমোতে পারেননি অবনীনাথ। কেমন যেন আচ্ছন্নতার মধ্যে কেটে গিয়েছিল। ডাক্তার চক্রবর্তী যেন এক টানে পর্দা সরিয়ে দিয়ে তাঁকে তাঁর মনেরই একটা গোপন অনাবিষ্কৃত অংশের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।
অনীতা সম্পর্কে তাঁর গভীর সহানুভূতি রয়েছে। কিন্তু তাকে কি সত্যি সত্যিই তিনি ভালোবাসেন? এটা ঠিক, ছুটিছাটায় দেশের বাড়িতে গেলে সারাক্ষণ অনীতার মুখ তাঁর চোখের সামনে ভাসতে থাকে। প্রায়ই ভাবেন, যে নোংরা দম-আটকানো পরিবেশে অনীতা রয়েছে, সেখানে থেকে সে মুক্তি পাক। শুভেচ্ছা বা সহানুভূতির বাইরে স্পষ্টভাবে এতকাল আর কিছু ভেবে দেখেননি অবনীনাথ। কিন্তু মনের যে দিকটা তাঁর নিজের কাছেই অজানা এবং সঙ্গোপন, আচমকা তার ওপর থেকে ঢাকনা খুলে দিয়েছেন ডাক্তার চক্রবর্তী। অনীতাকে পার্মানেন্টলি বাঁচাবার ব্যাপারে একটা ইঙ্গিতও তিনি দিয়েছেন। সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু তাঁর কী করা উচিত সেটাই ঠিক করে উঠতে পারছিলেন না অবনীনাথ। তবে বার বার এটা তাঁর মনে হচ্ছিল, যেমন করেই হোক অনীতাকে বাঁচানো দরকার।
সারারাত অনীতার কথা ভেবে পরের দিন প্রায় ঝিমুতে ঝিমুতে ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলেন অবনীনাথ। একটা ক্লাসের পর অন্য একটা ক্লাসরুমে যাবার সময় বাইরের করিডরে এসে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অনীতার বাবা অনিমেষ মুখার্জি দাঁড়িয়ে আছেন। অবনীনাথকে দেখামাত্র দ্রুত কাছে চলে এসেছিলেন। বলেছিলেন, আজ ভোরে ডিব্ৰুগড় থেকে এসেছি। এসেই যা শুনলাম তাতে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। এ তুমি কী করেছ অবনী?
জোরে জোরে গলা চড়িয়ে কথা বলছিলেন অনিমেষ। বেশ টের পাওয়া যাচ্ছিল, অবনীনাথের সঙ্গে বোঝাঁপড়া করার জন্য তাঁকে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু যেভাবে অনিমেষ চেঁচিয়ে কথা বলছেন তাতে চারপাশে ছেলেমেয়েরা শুনতে পাবে। অবনীনাথ তাঁকে নিয়ে সোজা কলেজ স্কোয়ারে চলে গিয়েছিলেন।
অনিমেষ ফের বলেছিলেন, তুমি নবকুমারকে এমনভাবে মেরেছ যে তাকে কম করে দশ দিন বিছানায় পড়ে থাকতে হবে। কেন ওকে এভাবে মারলে?
অবনীনাথ বলেছিলেন আপনার সঙ্গে ডাক্তার চক্রবর্তীর দেখা হয়েছে?
না। কেন?
আপনি তো আপনার স্ত্রী আর নবকুমারের ইনস্টিগেশনে আমার কাছে কৈফিয়ত চাইতে এসেছেন
অনিমেষ খতমত খেয়ে গিয়েছিলেন না, তা কেন। সব শুনে আমার ভীষণ খারাপ লাগল। আফটার অল এটা পারিবারিক স্ক্যান্ডাল
তাঁকে শেষ করতে না-দিয়ে অবনীনাথ বলেছিলেন, স্ত্রী আর নবকুমারের মতো একটা স্কাউড্রেলের কথায় না নেচে ডাক্তার চক্রবর্তীর সঙ্গে আগে কথা বলুন।
হ্যাঁ হ্যাঁ। নিশ্চয়ই বলব।
আপনার মেয়ে কেন বাড়ি ছেড়ে দূর সম্পর্কের মাসির বাড়ি চলে গেছেন তার খোঁজ নিয়েছেন?
না, মানে আমি অফিসের কাজে ডিব্রুগড়ে চলে গিয়েছিলাম। তখন ব্যাপারটা ঘটেছে। আজ বিকেলে একবার ব্যারাকপুর গিয়ে শুনে আসব।
হ্যাঁ। তাই শুনে আসুন, তারপর আমার যা কৈফিয়ত দেবার তাই দেব। তবে একটা কথা, মোটে দশ দিনের জন্য নবকুমার বিছানায় পড়ে থাকবে বলে আপশোস হচ্ছে। আগে বুঝতে পারলে হোল লাইফ ওকে বিছানায় শুইয়ে রাখার ব্যবস্থা করতাম।
যত দোষই করুক, ও কিছুদিন বাদে আমার জামাই হতে চলেছে। তাকে যদি মেয়ের এক বন্ধু মেরে মুখ ভেঙে দেয় তার রিপারকাশান কী হতে পারে, ভেবে দেখেছ! আত্মীয়-স্বজনরা যা-তা বলছে।