অবনীনাথ কী বলতে যাচ্ছিলেন, সেই সময় বাইরে একটা গাড়ি থামার আওয়াজ পাওয়া গেল। তারপরেই সদরে কড়া নাড়ার শব্দের সঙ্গে জড়ানো গলা ভেসে এল, দরজা খুলুন
নবকুমারের গলা। অবনীনাথ লক্ষ করেছিলেন, ডাক্তার চক্রবর্তী, তাঁর স্ত্রী এবং ছেলের মুখ শক্ত হয়ে উঠেছে। আর ভয়ে উদ্বেগে এবং দুশ্চিন্তায় শ্বাসরুদ্ধের মতো দেখাচ্ছিল অনীতাকে। তার মনোভাবটা বুঝতে পারা যাচ্ছিল। এমনিতেই সে এখানে চলে আসার জন্য লজ্জায় মাথা তুলতে পারে না। তার ওপর যদি তার জন্য আশ্রয়দাতাদের রোজ ঝঞ্ঝাটে পড়তে হয়, তাহলে সংকোচের শেষ থাকে না।
ওদিকে ডাক্তার চক্রবর্তী সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে সদর দরজা খুলে দিয়ে কর্কশ গলায় বলেছিলেন, আবার তুমি এসেছ! তোমাকে না বারণ করে দিয়েছি, এখানে আসবে না।
নবকুমারের চোখ-মুখ তখন আরক্ত এবং ঢুলুঢুলু। দারুণ টলছিল সে। দেখেই টের পাওয়া গিয়েছিল, প্রচণ্ড মদ্যপান করে এসেছে।
নবকুমার জড়ানো গলায় বলেছিল, মাইরি আর কি, আপনি বললেই আসব না! আমার উড-বি ওয়াইফকে আনলফুলি আপনি আটকে রেখেছেন। এটা কি ভালো হচ্ছে–
গেট আউট রাসকেল, গেল আউট-~~
আমি তো গেটের ভেতর ঢুকিনি, গেটের বাইরেই আছি। তাহলে আর আউট হতে বলছেন কেন?
মাতাল জন্তু কোথাকার?
ফর নাথিং গালাগাল দিচ্ছ কেন বৃদ্ধ! কদিন বাদে যে আমার ধর্মপত্নী হবে তাকে এভাবে আটকে রাখার মানে হয়। দিস ইজ ক্রুয়েলটি।
ডাক্তার চক্রবর্তী দুম করে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিলেন কিন্তু হাত বাড়িয়ে আটকে দিয়েছিল নবকুমার। বলেছিল, তুমি মাইরি অতি খচ্চর বুড়ো। এক ফোঁটা রসকস নেই। বিয়ে ফাইনাল হয়ে যাবার পর তুমি হলে তোমার শালা উড়-বি বউয়ের সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছা করত না?
জানোয়ারের মতো এই লোকটার অত্যন্ত ইতর কথাবার্তা শুনতে শুনতে আর তার নানারকম অঙ্গভঙ্গি দেখতে দেখতে মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল অবনীনাথের। নবকুমারের কথাগুলো শেষ হবার আগেই সে ক্ষিপ্তের মতো চিৎকার করে উঠেছিল, কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় জানো না হারামজাদা! জুতিয়ে তোমার মুখ আমি ভেঙে দেব!
আচমকা ইলেকটিক শক খাওয়ার মতো ঝট করে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল নবকুমার। দুচোখ থেকে নেশার টুলুঢুলু ভাবটা মুহূর্তে ছুটে গিয়েছিল তার। চোখের পাতা টানা করে কয়েক সেকেন্ড অবনীনাথকে লক্ষ করেছিল সে। তারপর বলেছিল, চেনা চেনা লাগছে যেন। ও তুমি সেই খচ্চরটা না? এখানে এসে হাজির হয়েছ চাঁদ! বলেই গলার স্বরটা দুম করে দশ গুণ চড়ায় তুলে চেঁচিয়ে উঠেছিল, শুয়ারকা বাচ্চা! তুমি কোন তালে এখানে ঘুর ঘুর করছ আমি জানি না? আমাকে জুতবি? বেজন্মা যদি না হোস, বেরিয়ে আয়
নিজের মধ্যে সেই মুহূর্তে কী প্রতিক্রিয়া ঘটে গিয়েছিল, এতকাল পর আর মনে পড়ে না। কেউ কিছু বলা বা বাধা দেবার আগেই উন্মত্তের মতো অবনীনাথ বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে উঠোনে নেমে এসেছিলেন; তারপর ডাক্তার চক্রবর্তীকে এক ধাক্কায় সরিয়ে একেবারে নবকুমারের মুখোমুখি।
…জ্ঞান যখন ফিরল তখন সারা মুখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে নবকুমারের; হাড় এবং চোয়ালের হাড় ভেঙে গেছে। আর তার বুকের ওপর বসে ঘুষির পর ঘুষি মেরে চলেছেন তিনি।
ডাক্তার চক্রবর্তী, তাঁর ছেলে, স্ত্রী এবং অনীতাই শেষ পর্যন্ত টানাটানি করে দুজনকে আলাদা করে দিতে পেরেছিলেন। রক্তাক্ত মুখে কোনোরকমে পুঁকতে ধুঁকতে তার গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়েছিল নবকুমার। যাবার সময় মুখ বাড়িয়ে বলে গিয়েছিল, সান অব এ বিচ, তোর কথা আমার মনে থাকবে।
অবনীনাথ বলেছিলেন, আমিও তাই চাই। এবার তবু উঠে যেতে পারলি। এরপর অনীতার পেছনে তোকে দেখলে শিরদাঁড়া গুঁড়ো করে দেব।
যা-যা–অকথ্য একটা খিস্তি দিয়ে চলে গিয়েছিল নবকুমার।
মদ্যপ জন্তুটাকে মারধোর করে হাত-পা কেটে-কুটে রক্ত ঝরছিল অবনীনাথের। ডাক্তার চক্রবর্তী তাঁকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে রক্ত-টক্ত মুছিয়ে ড্রেস করে দিতে দিতে জিগ্যেস করেছিলেন, কী ব্যাপার বলো তো?
অবনীনাথ তাঁর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, কী?
হঠাৎ ওই জানোয়ারটার ওপর তুমি ওরকম খেপে গেলে কেন? খিস্তি খেউড় ও যা করেছিল তা তো আমাকে।
তা ঠিক। কিন্তু শুনতে শুনতে নিজেকে আর চেক করতে পারিনি।
আমার কিন্তু অন্যরকম মনে হচ্ছে
কী?
এখন বলব না। প্রচুর মারদাঙ্গা করেছ, যথেষ্ট ব্লিডিং হয়েছে। আগে কিছু খেটে-টেয়ে শক্তি সঞ্চয় করো। তারপর যাবার সময় গোপনে বলে দেব। বলে একটু থেমে পরক্ষণে আবার শুরু করেছিলেন ডাক্তার চক্রবর্তী, হারামজাদাটাকে রাইটলি সার্ভ করেছ। এরকম লেসন ওর অনেক আগেই পাওয়া উচিত ছিল। তা হলে এতটা বাড়তে সাহস পেত না। সমস্ত দোষ আমার স্পাইনলেস ভায়রাটির। যাই হোক, কনগ্রাচুলেসন্স ফর অ্যান একসেলেন্ট পারফর্মেন্স।
অনীতার মাসি বলেছিলেন, লোকটা শাসিয়ে গেল। তুমি একটু সাবধানে থেকো বাবা।
অনীতা বসেছিল, খুব খারাপ লোক। ও না-পারে হেন কাজ নেই।
অবনীনাথ বলেছিলেন, মরালি কাওয়ার্ড লোকদের মুখই সর্বস্ব। কিছু করার ক্ষমতা ওদের নেই। দেখলে না কেমন কুকুরের মতো পালিয়ে গেল।
তবু সাবধানে থাকবে।
আমার জন্যে ভেবো না। কাল থেকে ক্লাস করতে যেও। আমার ধারণা বদমাশটার শিক্ষা হয়েছে। ও আর তোমার পেছনে লাগতে সাহস করবে না।