অভীকের সঙ্গে কথা হয়ে যাবার পর সেদিনই রাঁচিতে বড় মেয়ে-বড় জামাই আর বম্বেতে ছোট ছেলে-ছোট বউমাকে টাঙ্ক কলে ধরে চলে আসতে বলেছেন। কারো কোনোরকম অসুবিধে বা আপত্তির কথা কানে তোলেননি। জোর না-খাটালেও অবনীনাথের ব্যক্তিত্ব এমনই প্রবল যে ছেলেমেয়েরা তার মুখের ওপর কথা বলতে পারে না। বড় মেয়ে-জামাই কাল বিকেলে রাঁচি থেকে চলে এসেছে। ছোট ছেলে-ছোট বউমা স্পেশাল লিভ নিয়ে আজ দুপুরের ফ্লাইটে এসেছে বম্বে থেকে। ছোট মেয়ে এবং ছোট জামাই-এর এদিক থেকে কোনো অসুবিধা নেই; ওরা কলকাতেই থাকে।
হঠাৎ এভাবে ডেকে আনার জন্য ছেলেমেয়ে এবং তাদের স্ত্রী বা স্বামীরা খুবই অবাক হয়েছে। এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে প্রচুর আলোচনাও হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ওদের মোটামুটি ধারণা হয়েছে, টাকা-পয়সা বা বাড়ি-টাড়ি সম্পর্কে উইলের জন্য অবনীনাথ ওদের আসতে বলেছেন। ছেলেমেয়েরা জানে কাকাতায় এই একটা তেতলা বাড়ি এবং ব্যাঙ্কে লাখ আড়াই টাকা ছাড়া অবনীনাথের আর কিছু নেই। তারা আগেই জানিয়ে দিয়েছে, পৈতৃক প্রপার্টি বা টাকাপয়সা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা নেই; এসব তিনি যাকে ইচ্ছে দিয়ে যেতে পারেন। কোনো চ্যারিটেবল প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে গেলেও তাদের আপত্তি নেই। কাজেই আবার মনে হয়েছে, উইলের জন্যই হয়তো এভাবে বাবা তাদের ডেকে আনেননি। নিশ্চয়ই অন্য কোনো জরুরি কারণ আছে।
অবনীনাথ বলেছিলেন, কাঁটায় কাঁটায় চারটেয় সবাই যেন বসবার ঘরে চলে আসে। ছেলেমেয়েরা চারটের অনেক আগে থেকেই অপরিসীম কৌতূহল এবং কিছুটা উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে আছে।
ঘরে একটা মাত্র সোফাই এখন খালি আছে। অবনীনাথ আস্তে আস্তে সেটায় গিয়ে বসলেন। এটায় বসলে অন্য সবাইকে দেখতে সুবিধা হয়। খুব সম্ভব এই কারণে তাঁর জন্য সোফাটা রেখে দিয়েছিল ওরা। অবনীনাথ কবজি উলটে ঘড়ি দেখলেন, চারটে বাজতে এখনও কয়েক সেকেন্ড বাকি। অভীকদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি ঠিক সময়েই এসে গেছি।
ছেলেমেয়েরা জানে অবনীনাথ আজীবন ব্রিটিশ পাংচুয়ালিটি মেনে চলেছেন। একটু মজা করে অভীক বলল, আর্লিয়ার বাই ফিফটিন সেকেন্ডস।
অবনীনাথ সামান্য হাসলেন। আরেকবার সবাইকে দেখলেন। অভীক অঞ্জন সুদীপা রঞ্জনা এবং তাদের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া মৃদুলা চৈতী মৃন্ময় আর চিরদীপ-তাঁর নিজের সৃষ্টি এই পরবর্তী জেনারেশনের সবাই কৃতী, সফল, কোনো-না-কোনো ভাবে ব্রিলিয়ান্ট। এদের সম্বন্ধে তাঁর কোনোরকম দুশ্চিন্তা বা সমস্যা নেই। সবাইকে জীবনে নিজের হাতে তিনি প্রতিষ্ঠিত করে দিতে পেরেছেন। জীবনের লম্বা ম্যারাথন দৌড় শেষ করে এখন তিনি প্রায় ভারমুক্ত।
অবনীনাথ বললেন তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ বিশেষ প্রয়োজন না হলে জোর করে তোমাদের এখানে টেনে আনতাম না। জানি, এভাবে ছুটে আসার জন্য তোমাদের অনেক অসুবিধে হয়েছে কিন্তু এ ছাড়া আমার উপায় ছিল না। একটু থেকে আবার শুরু করলেন, কী কারণে তোমাদের এখানে আসতে বলেছি, খুব সম্ভব আন্দাজ করতে পারছ না। যাই হোক, আমি তোমাদের আর সাসপেন্সের মধ্যে রাখতে চাই না। আমার বয়স এখন একষট্টি চলছে। ছমাস আগে রিটায়ার করেছি। পৃথিবীতে আমার জন্য নির্দিষ্ট সব কাজই প্রায় শেষ হয়েছে। তোমাদের সবাইকে মানুষ করতে পেরেছি। এ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা নেই। তোমাদের মা দশ বছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। সেদিক থেকেও আমি মুক্ত। কোনো ব্যাপারেই আমার এখন আর দায়িত্ব বা বন্ধন থাকার কথা নয়। কিন্তু আমার ধারণা, এখনও একটা বড় কাজ আমার বাকি আছে। সেটা শেষ না হলে আমার লাইফের সাইকেল কমপ্লিট হবে না। অসীম গ্লানি আর পাপের কষ্ট নিয়ে আমাকে মরতে হবে।
সবাই উদগ্রীব হয়ে অবনীনাথের দিকে তাকিয়ে ছিল। অভীক বিমূঢ়ের মতো জিগ্যেস করল, তোমার কী কাজ বাকি আছে?
অবনীনাথ বললেন, সেটা বলার জন্যেই তোমাদের ডেকে এনেছি। জীবনের শেষ চ্যাপ্টারে পৌঁছে আমি নিজের সম্পর্কে একটা ভাইট্যাল ডিসিশন নিয়েছি।
কীসের ডিসিশান?
সেটা পরে বলব। তার আগে একটা প্লেন টুথ মানে সরল সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাই। কিন্তু তোমাদের মনে রাখতে হবে সত্য বড় নিষ্ঠুর।
অঞ্জন বলল, তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না বাবা।
অবনীনাথ ডান হাতটা সামান্য তুলে বললেন, একটু অপেক্ষা করো; সব বুঝতে পারবে। বলে কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। তারপর সবাইকে দেখতে দেখতে আবার শুরু করলেন, আমি জানি তোমরা আমাকে কী চোখে দ্যাখো। তোমাদের কাছে আমি একজন সুপারম্যান-সৎ, মহৎ, কর্তব্যপরায়ণ। তোমরা হয়তো ভাবো একজন আইডিয়াল ফাদারের মডেল যা হওয়া উচিত, আমি হলাম তাই। মনে মনে দুহাজার ফুট ওপরে একটা বেদিতে আমাকে বসিয়ে ফুল-টুল দিয়ে সাজিয়ে রেখেছ। তোমরা আমাকে নিয়ে যে মিথ তৈরি করেছ তা ভাঙার ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু মিথ-র চেয়ে সত্য অনেক বড়, অনেক বেশি পাওয়ারফুল। একদিন তার সামনে দাঁড়াতেই হয়। আমার এই একষট্টি বছর বয়সে সেই সময় এসেছে।
অভীক, অঞ্জন, মৃদুলা বা চিরদীপ–কেউ কোনো কথা বলল না। সবাই শ্বাসরুদ্ধের মতো বসে রইল।
অবনীনাথ বলতে লাগলেন, আমি যেমন, তোমাদের বাবা তেমনই একজন রক্তমাংসের মানুষ। পৃথিবীর তিনশো কোটি ইনডিভিজুয়ালের আমি একজন। আমার এই শরীর বা মন কোনোটাই শুধুমাত্র কর্তব্যবোধ, আদর্শ, ন্যায় নীতি–এমনি ভালো ভালো পবিত্র জিনিস দিয়ে বোঝাই নয়। আর সব মানুষের মতো আমিও নানারকম প্রবৃত্তির স্প্রেভ। আমার মধ্যে কামনা, আকাঙ্ক্ষা, প্যাশান ছাড়াও এমন সব ইনস্টিংক্ট আছে যার কথা শুনলে তোমরা শিউরে উঠবে। তোমরা এত কাল যে অবনীনাথ চ্যাটার্জিকে আইডিয়াল গৃহস্থ, আইডিয়াল স্বামী, আইডিয়াল অধ্যাপক, আডিয়াল সামাজিক প্রাণী আর মডেল বাবা হিসেবে দেখে এসেছ, এগুলো তার ছদ্মবেশ। একটা লোক একই সঙ্গে একষট্টি বছর পর্যন্ত কত ভূমিকায় অভিনয় করে গেল, কিন্তু সে এতই দুর্দান্ত অ্যাক্টর যে কেউ আসল মানুষ্টাকে ধরতে পারল না; এমনকী তার সন্তানেরাও নয়। কিন্তু এখন বাইরের মেক আপ তুলে সবার সামনে নিজেকে দাঁড় করাবার সময় হয়েছে। তোমাদের কাছে আমার কিছু কনফেসান আছে। সব শুনে তোমরা ঠিক করবে আমি কতটা মহৎ বা কতটা ঘৃণ্য।