কিন্তু আমি তো তোমাকে কোনোভাবেই সাহায্য করতে পারি না।
তুমি থাকলেই আমি অনেকখানি সাহস পাই।
২. পুজোর ছুটির পর
সেবার পুজোর ছুটির পর ইউনিভার্সিটি খুললে কলকাতায় এলেন অবনীনাথ। আগের দিন রাতে টেনে উঠেছিলেন। হাওড়ায় পৌঁছেছিলেন ভোরে। মামার বাড়িতে গিয়ে স্নান-টান করে খেয়ে-দেয়ে সোজা চলে গিয়েছিলেন ইউনিভার্সিটিতে। ছুটির পর প্রথম দিনটা যে-যার মতো ক্লাস করতে যেত। পরের দিন থেকে কার কখন ক্লাস শুরু, জেনে নিয়ে একজন আরেকজনের জন্য অপেক্ষা করত।
ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে সেদিন অনীতার সঙ্গে দেখা হয়নি। দুটো বছরে সামার ভেকেসান, পুজো ভেকেসান, এক্সমাস ইত্যাদি মিলিয়ে কম ছুটি পড়ত না। যে ছুটিই পড়ুক, তারপর ইউনিভার্সিটি খুললে প্রথম দিনেই এতকাল অনীতার সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু সেবার কী হয়ে গিয়েছিল, কে জানে! অনীতার সঙ্গে দেখা না-হওয়ায় খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন অবনীনাথ। বাড়ি ফিরে মামিকে অনীতার কথা জিগ্যেস করেছিলেন। মামি বলেছিলেন, ও এখন আর এখানে থাকে না। কদিন হল ব্যারাকপুরে ওর দূর সম্পর্কের মাসির কাছে চলে গেছে।
অবনীনাথ চমকে উঠেছিলেন, কেন?
ওই যে সেই বদমাইশটা, যার সঙ্গে ওর বিয়ের কথা হয়েছিল ভীষণ উৎপাত শুরু করে দিয়েছিল। তার সঙ্গে ছিল ওর সত্য। অতিষ্ঠ হয়ে বাড়ি ছেড়ে ওকে চলে যেতে হয়েছে।
অনীতার বাবা এখানে নেই?
না। ডিব্রুগড়ে গেছেন কদিনের জন্য।
সেই মুহূর্তে অনীতাকে দেখার জন্য খুবই অস্থির হয়ে উঠেছিলেন অবনীনাথ। জিগ্যেস করেছিলেন, ব্যারাকপুরে ওর মাসির বাড়িটা কোথায়?
মামি সোজাসুজি চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন। আস্তে করে বলেছিলেন, কেন?
অবনীনাথ পারতপক্ষে যা কখনও করেননি তাই করেছিলেন। চোখ-কান বুজে মিথ্যে বলেছিলেন, অনীতার কাছে ওর এক বন্ধুর অনেকগুলো নোট আছে। কালই সেগুলো চাই, খুব জরুরি দরকার।
মামি বলেছিলেন, ঠিকানাটা বলতে পারব না। তবে ওর মেসো ডাক্তার; স্টেশনের খুব কাছেই তাঁর চেম্বার। পুরো নাম জানি না; ডাক্তার চক্রবর্তী বললেই নাকি ওখানকার লোক চিনে ফেলবে। কিন্তু একটা কথা
কী?
যদি সত্যিই সেখানে যাও, নোটগুলো নিয়েই চলে আসবে। নিজেকে কোনো ব্যাপারে জড়াবে না। তোমার ওপর তোমাদের সংসারের ভবিষ্যৎ সবকিছুই নির্ভর করছে।
মামি কী ইঙ্গিত করেছিলেন বুঝতে অসুবিধা হয়নি অবনীনাথের। তিনি মুখে কিছু বলেননি, আস্তে মাথা নেড়েছিলেন শুধু।
যাই হোক, সেদিন আর ব্যারাকপুর যাননি অবনীনাথ।
পরের দিনও ইউনিভার্সিটিতে আসেনি অনীতা। ছুটির পর অবনীনাথ সোজা শিয়ালদা গিয়ে ব্যারাকপুরের ট্রেন ধরেছিলেন।
সন্ধের সময় গাড়ি থেকে নেমে স্টেশনের গায়ে ডাক্তার চক্রবর্তীর চেম্বার খুঁজে বার করতে অসুবিধা হয়নি। অনীতার কথা বলতেই ডাক্তার চক্রবর্তী প্রায় কেঁপে উঠেছিলেন, তুমি আবার কে? সেই হারামজাদার বাচ্চাটার মতো আরেকজন ক্যান্ডিডেট না কি?
অবনীনাথ হকচকিয়ে গিয়েছিলেন, মানে আপনি কার কথা বলছেন?
সেই যে শূকরের শাবকটি কী যেন নাম, ও হ্যাঁ, নবকুমার। মেয়েটা আসার পর এখানে রোজ হানা দিচ্ছে। ছাল ছাড়িয়ে নেওয়া উচিত। তোমার মতলবটা কী হে ছোকরা?
অনীতা সম্পর্কে অবনীনাথের উৎকণ্ঠা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। নবকুমার তা হলে এখানে এসেও ঝামেলা পাকাচ্ছে। তিনি ডাক্তার চক্রবর্তীকে সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে জানিয়েছিলেন, কোনও রকম মতলব নিয়েই তিনি এখানে আসেননি। তাঁরা ইউনিভার্সিটিতে পড়েন, কলকাতায় এক পাড়ায় থাকেন, এখন কিছু ক্লাসনোট সম্পর্কে অনীতার সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়া দরকার।
ডাক্তার চক্রবর্তী পাগলাটে টাইপের মানুষ। যত দ্রুত তিনি খেপে ওঠেন তত দ্রুতই শান্ত হয়ে যান। বলেছিলেন, দ্যাটস ফাইন। মতলব না থাকলেই হল। তুমি তো অনুর বাপকে চেনো?
চিনি।
এরকম স্পাইনলেস ভেঁড়ুয়া লোক ওয়ার্ল্ডে দ্বিতীয়টি জন্মায়নি। তরুণী ভার্যার ভয়ে সবসময় কাঁপছেন। আসলে সেক্স বুঝলে, সেক্সের জন্যে মানুষ ছাগল বনে যায়। ছাগল হ, পাঁঠা হ, কেন্নো হ, ছুঁচো হ, কিছু যায় আসে না। তুই ব্যাটা একটা ফাদারও তো। কোথায় লুচ্চা বদমাইশটার চামড়া খুলে নিবি, তা না, নানারকম ফেরেব্বাজি করে মেয়েকে তার হাত থেকে বাঁচাতে চাইছিস!
অবনীনাথ বুঝতে পারছিলেন, অনীতার পাকা দেখার অনুষ্ঠানটা যে একটা বিরাট ক্যামোফ্লেজ সেটা টের পেয়ে গেছেন ডাক্তার চক্রবর্তী। তিনি এবার বলেছিলেন, চলো হে ছোকরা, অনুর সঙ্গে দেখা করতে চলো।
সাইকেল রিকশায় করে গঙ্গার ধারে ছিমছাম একটা দোতলা বাড়িতে অবনীনাথকে নিয়ে এসেছিলেন ডাক্তার চক্রবর্তী।
অবনীনাথ যে ব্যারাকপুর পর্যন্ত আসবে, অনীতা ভাবতে পারেনি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল সে।
অবনীনাথ নরম গলায় বলেছিলেন, কেঁদো না অনীতা, কেঁদো না—
অনীতা বলেছিল, জানো, ওই লোকটা এখানে এসেও গোলমাল করছে।
ডাক্তার চক্রবর্তী যে অনীতা সম্পর্কে খুবই সহানুভূতিশীল তা আগেই টের পেয়েছিলেন অবনীনাথ। মিসেস চক্রবর্তীও যে দূর সম্পর্কের মৃত বোনের মেয়ের ব্যাপারে উদাসীন নন, সেটাও বোঝা গিয়েছিল।
অনীতার মাসি মিসেস চক্রবর্তী বলেছিলেন, ইচ্ছা করে পুলিশ ডেকে বজ্জাতটাকে ধরিয়ে দিই। কিন্তু ভয় হয় এই নিয়ে পরে কেলেঙ্কারি হবে; মেয়েটার ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে। তাই মুখ বুজে সব সয়ে যেতে হচ্ছে।