এই সময় অনিমেষ গভর্নমেন্টের পে অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট থেকে মিলিটারির একটা ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলেন। ওয়ার সারভিস একটা সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার। প্রায় দিন-রাতই তখন অনিমেষের ডিউটি। মাসের ভেতর দশ-পনেরো দিন তাকে বাইরে থাকতে হত–কখনও শিলং, কখনও ডিব্ৰুগড়, কখনও সদিয়া বা তিনশুকিয়া। বাড়িতে থাকত অনীতা, সুরমা আর তার দুটো ছেলেমেয়ে।
এদিকে নবকুমার গভর্নমেন্ট সারভিস ছেড়ে দিয়ে কনস্ট্রাক্টরি বিজনেসে নেমে গিয়েছিল। যুদ্ধের দৌলতে তখন চারদিকে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, এয়ারোড্রোম, মিলিটারি ব্যারাক তৈরি হচ্ছে। চারদিকে টাকা, টাকা আর টাকা। হাত বাড়িয়ে শুধু ধরতে পারলেই হয়।
নবকুমারের বিজনেস ব্রেন দারুণ পরিষ্কার। দুদিনেই এ-লাইনের সব ঘোঁত-ঘাঁত জেনে নিয়েছিল। টপ র্যাঙ্কের ব্রিটিশ আর আমেরিকান মিলিটারি অফিসারদের হুইস্কির পেটি আর মেয়েমানুষ সাপ্লাই দিয়ে বিরাট সব কনটাক্ট বাগিয়ে ফেলতে লাগল সে। টাকা আসতে লাগল হুড়হুড় করে প্রায় ঢলের মতো। কয়েক মাসের ভেতর দুটো নতুন মডেলের ঝকঝকে ফরেন গাড়ি আর গোটাতিনেক বাড়ি কিনে ফেলেছিল সে। আগে কম করে একটু আধটু-ড্রিংক করত, পরে সেটার মাত্র, দশগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।
লাখ লাখ টাকা কামাক, গাড়ি-বাড়ি করুক, হুইস্কির সমুদ্রে ভেসে যাক–যা ইচ্ছা নবকুমার করে যাক, অনীতার মাথাব্যথা নেই, কিন্তু যুদ্ধের বাজারের অঢেল টাকা একেবারেই বেপরোয়া করে তুলেছিল নবকুমারকে। অনিমেষ যখন অফিসের কাজে বাইরে বেরিয়ে টুরে ঘুরে বেড়াতেন তখন একেকদিন রাত্তিরবেলা মদে চুর হয়ে নতুন গাড়ি ড্রাইভ করে চলে আসত সে। জড়ানো গলায় চিৎকার করে বলত, বিয়ে যখন ফাইনাল হয়ে গেছে তখন অনীতা তার বউ-ই। এম. এ পড়ার আর দরকার নেই। সব শালা কনট্রাক্টরের বউ আছে, বউদের নিয়ে তারা মেজর, লেফটেন্যান্ট কর্নেলদের সঙ্গে খানাপিনা করে, পার্টিতে যায়। এতে বিজনেসের কত সুবিধে। পড়াশোনা করে কদ্দর আর অনীতা তাকে এগিয়ে দেবে। তার চাইতে চটপট বিয়েটা করে নবকুমারের সঙ্গে পার্টিটাতে গেলে তার যথেষ্ট উপকার হবে। যুদ্ধের সময়টা হল টাকা কামাবার সিজন। স্ত্রী না থাকলে ফিউচারে আর ভালো কনটাক্ট-টনটাক্ট পাওয়া সম্ভব হবে না। অতএব সে যা বলে অনীতাকে তাই করতে হবে…ইত্যাদি ইত্যাদি। কী করে যে জন্তুর মতো বেপরোয়া, পয়সার জোরে প্রবল শক্তিমান এই লোকটাকে ঠেকিয়ে গেছে, অনীতাই শুধু জানে।
এদিকে দুবছরে অনীতার অনেক কাছাকাছি এসে পড়েছিলেন অবনীনাথ। ইউনিভার্সিটিতে যাবার বা ফেররে সময় অনীতার সঙ্গে তাঁর দেখা হত। তবে ওদের বাড়ি চিৎ কখনো যেতেন অবনীনাথ।
যাই হোক, ফিফথ আর সিকথ ইয়ার–এই দুটো বছর একটানা কলকাতায় থাকা হয়নি অবনীনাথের। ছুটিছাটা হলেই দেশে চলে যেতেন তিনি।
এই দুবছরে তাঁদের পারিবারিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ভাই-বোনগুলোর ঠিকমতো খাওয়া জুটত না। অবনীনাথ বুঝতে পারছিলেন গোটা সংসার তার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।
বাড়ি গেলে অনীতার মুখ সারাক্ষণ অবনীনাথের চোখের সামনে ভাসত, তার জন্য উল্কণ্ঠা এবং দুর্ভাবনায় মনটা ভরে থাকত। সবসময় ভাবতেন ছুটিতে বাড়ি এসে ভালো করেননি। হয়তো কলকাতায় ফিরে গিয়ে দেখবেন, অনীতার কোনো ক্ষতি হয়ে গেছে। হাজার হলেও মেয়ে তো। কতদিন আর এক হাতে তার পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব? কিন্তু বাড়ি না-এলেও নয়। বাবা-মা ভাই-বোনেরা কবে অবনীনাথের ছুটি পড়বে সেজন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। আর বাড়ি এসে কলকাতায় এক দুঃখী অসহায় মেয়ের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে থাকতেন অবনীনাথ। খেতে ইচ্ছা করত না, রাতগুলো জেগে কেটে যেত।
সে আমলে অনাত্মীয় কোনো মেয়েকে চিঠি লেখার চল ছিল না। ইচ্ছা যে হত না তা নয়। কিন্তু পরক্ষণেই ভয় হত, কার হাতে পড়বে, কে এর কী মানে করে বসবে। তাই নিয়ে পরে একটা বিশ্রী কেলেঙ্কারি ঘটে যেতে পারে।
ছুটির পর কলকাতায় ফিরে এলে অনীতা জিগ্যেস করত, কেমন কাটল ছুটিটা? খুব মায়ের আটর-টাদর খেয়ে এলে
তা তো খেলাম। তবে
তবে কী? গম্ভীর গলায় বলত অনীতা।
দ্বিধান্বিতের মতো খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে অবনীনাথ বলতেন, না কিছু না
একেবারেই কিছু না?
হয়তো কিছু, কিন্তু বলতে ভরসা পাই না।
অনীতা সামান্য হাসত, এতই বিপজ্জনক ব্যাপার নাকি?
অবনীনাথ উত্তর দিতেন না। তাঁর বলতে ইচ্ছা করত ছুটির সময় কলকাতা থেকে একশো মাইল দূরে বসে একটি দুঃখী মেয়ের মুখ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেননি। তাঁর স্মৃতি এবং অস্তিত্বের ওপর মেয়েটি যেন ব্যাপ্ত হয়ে থেকেছে। কিন্তু এ কথা কী করে তাকে বলা যায়?
অবনীনাথ জিগ্যেস করতেন, তোমার ছুটি কীভাবে কাটল?
অনীতা পরিপূর্ণ চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলত, সত্যি কথাই বলব তো?
নিশ্চয়ই।
তোমার কথা ভেবে।
গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত অবনীনাথের। দুর্বল জড়ানো গলায় কী বলতেন, ঠিক বোঝা যেত না।
দুঃখের কথা বলার মতো মানুষের তো কাউকে চাই। তুমি ছাড়া আমার তেমন কেউ নেই। ছুটিতে তুমি চলে গেলে বড় কষ্ট হয়। মনে হয় আর পারব না, ওরা আমাকে ভেঙে গুঁড়ো করে দেবে। তাই ছুটি যেদিন থেকে পড়ে সেদিন থেকেই ভাবতে বসি কবে ছুটি শেষ হবে। কবে তুমি দেশ থেকে ফিরবে।