কিন্ত অনীতা বাবার ওপর বিশেষ ভরসা রাখতে পারছিল না। তাঁর মনের জোর এত কম, চরিত্রের ভিত এত নড়বড়ে যে খুব চাপ দিলে হয়তো নবকুমারের সঙ্গে সত্যিকারের বিয়েতেই রাজি হয়ে যাবেন। মনে মনে এর জন্য খুবই কষ্ট পাবেন তিনি কিন্তু মেরুদণ্ড টান টান করে এর বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মতো শক্তি বা সাহস জুটিয়ে উঠতে পারবেন না। কাজেই অনীতা ঠিক করে ফেলেছিল বাবাকে সামনে দাঁড় করিয়ে যেটুকু যুদ্ধ করার সেটা তাকে নিজেকেই করতে হবে।
যাই হোক, অনিমেষ যখন কথা দিয়েছেন তখন বিয়ের ব্যাপারটা ফাইনাল করতেই হয়েছিল। কারণ এই কথার সঙ্গে বাবার সম্মান জড়ানো ছিল। তবে খুব সহজে এটা ঘটতে দেয়নি অনীতা, পড়াশোনা, শরীর খারাপ ইত্যাদি একেকটা বাধা সামনে দাঁড় করিয়ে অনেক দিন পর্যন্ত আটকে রেখেছিল।
বিয়ের কথা ফাইনাল হবার দিন কয়েক পর অনীতা ডাকে একটি মহিলার চিঠি পায়। তাতে লেখা ছিল, নবকুমার তার সঙ্গে কিছুকাল স্বামী-স্ত্রীর মতো থেকেছে। তারপর তাকে ছেড়ে চলে গেছে। শুধু তার-ই না, আরো বহু মেয়ের ক্ষতি করেছে নবকুমার। মহিলাটি কীভাবে যেন অনীতার সঙ্গে নবকুমারের বিয়ের খবর পেয়েছিল, অনেক কষ্টে তাদের ঠিকানা জোগাড় করে এই চিঠি পাঠিয়েছে। উদ্দেশ্য নবকুমারের হাত থেকে একটি মেয়েকে বাঁচানো।
চিঠির কথা কাউকে জানায়নি অনীতা। তবে নবকুমার সম্পর্কে আরও সতর্ক হয়ে উঠেছে। এম. এটা পাশ না-করা পর্যন্ত তার অধৈর্য বা উত্তেজিত হওয়া চলবে না। ইচ্ছা করলে পায়ের থেকে জুতো খুলে নবকুমারের মুখে বসিয়ে দিতে পারত অনীতা কিন্ত তৎক্ষণাৎ তাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হত। বাড়ি ছাড়ার জন্য সে পা বাড়িয়েই ছিল। কিন্তু বেরিয়ে গিয়ে রাস্তায় তো তার মতো একটি তরুণীর পক্ষে থাকা সম্ভব না। কোথাও গিয়ে তাকে উঠতে হয়। তা নাহয় উঠল, কিন্তু খরচ চলবে কী করে? বাবার যা রোজগার তাতে একসঙ্গে থাকলে ভালোভাবেই চলে যায় কিন্তু আলাদা করে তাকে টাকা দেওয়া অসম্ভব। তা ছাড়া তাকে ওভাবে টাকা দিলে সুরমা আর বাবার মধ্যে অশান্তি অনিবার্য।
এ তো গেল একটা দিক; বিয়ের কথা ফাইনাল হবার পর নবকুমার চাইত, অনীতাকে নিয়ে বেড়াতে বেরোয়। একটা টু-সিটার আছে তার; সেটা নিয়ে রোজ এসে ঘ্যানর ঘ্যানর করে। প্রথম দিকে বাড়িতে এসে যাবার জন্য জেদ ধরত। পরে কদিন ধরে ইউনিভার্সিটিতে হানা দিতে শুরু করেছে।
অনীতার ধারণা নবকুমারের সঙ্গে একা একা বাইরে বেরুনো খুবই বিপজ্জনক। তাই সে তাকে প্রাণপণে এড়িয়ে যাচ্ছে।
বাড়িটা ভীষণ অহস্য লাগে অনীতার, সবসময় মনে হয় একটা বিস্ফোরকে ঠাসা ঘরের ভেতর তাকে আটকে রাখা হয়েছে। নিজে দুঃখ কষ্ট আর দুশ্চিন্তা ভুলবার জন্য তাই সে বাইরে হাসি-খুশি থাকতে চেষ্টা করে; বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে মজা-টজা করে।
এই হচ্ছে অনীতার তেইশ বছরের জীবনের ব্যাকগ্রাউন্ড। ডাবল ডেকারের ফ্রন্ট সিটে পাশাপাশি বসে তার কথা শুনতে শুনতে গভীর সহনুভূতিতে মন ভরে গিয়েছিল অবনীনাথের।
বিষণ্ণ একটু হেসে অনীতা বলেছিল, ঝোঁকের মাথায় সব বলে গেলাম। নিশ্চয়ই তোমার খুব খারাপ লাগল।
অবনীনাথ উত্তর দেননি।
সেদিন ইউনিভার্সিটি থেকে নবকুমারকে ফিরিয়ে দিয়ে বাড়ি যাবার পর কী ঘটেছিল, নিজে অনীতা বলেনি। তবে জানার জন্য খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন অবনীনাথ। পরের দিন ইউনিভার্সিটিতে যাবার সময় কথাটা তিনি জিগ্যেস করেছিলেন। অনীতা মলিন হেসে বলেছিল, আন্দাজ করে নাও। ডিটেলসে বলে আর কী হবে?
অবনীনাথ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলেন, জানোয়ারটার হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে যাও
তাই তো করছি।
এ ব্যাপারে আমাকে যদি কোনওভাবে দরকার হয় বলো। কথাগুলো বলেই চমকে উঠেছিলেন অবনীনাথ। নিজের অজান্তে এ তিনি কী বলে ফেললেন।
অনীতা বলেছিল, তুমি যা বললে, এমন করে আগে আর কেউ বলেনি। তোমার কাছে সারাজীবন আমি কৃতজ্ঞ থাকব। তবে–তুমি বড় ভালো ছেলে। এই নোংরা ব্যাপারে তোমাকে জড়াতে চাই না। প্লিজ, আমাকে ভুল বুঝো না।
একটু চুপচাপ। তারপর অবনীনাথ বলেছিলেন, ঠিক আছে, জড়িও না। তবে একটা অনুরোধ করব
কী?
তুমি নিশ্চয়ই আমাকে তোমার শুভাকক্ষী ভাবো?
নিশ্চয়ই।
তাহলে তোমার সঙ্গে ওরা কীরকম ব্যবহার করছে রোজ আমাকে জানিও।
কিছুক্ষণ ভেবে অনীতা বলেছিল, ঠিক আছে, জানাব।
এরপর থেকে নবকুমার আর সুরমা কীভাবে তাকে কষ্ট দিচ্ছে আর এ-ব্যাপারটা কিছুটা জেনে এবং বা কিছুটা আন্দাজ করে কীভাবে অনিমেষ অসহায়ের মতো দেখে যাচ্ছেন, সব বলে যেতে অনীতা। তবে নবকুমার কোনো দিনই তাকে একা একা বেড়াতে নিয়ে যেতে পারেনি। ওই জায়গাটায় অনমনীয় ছিল অনীতা।
এইভাবেই প্রায় দুটো বছর কেটে গিয়েছিল। আর এই দুবছরের মধ্যে সেকেন্ড গ্রেট ওয়ার শুরু হয়ে গেছে।
কলকাতার পার্কে পার্কে তখন ট্রেঞ্চ, বড় বড় বাড়ির সামনে বাফেলো ওয়াল, রাস্তায় রাস্তায় এ-আর-পি। রাত্তিরে ব্ল্যাক আউট। চারদিকে মিলিটারিদের ছাউনি পড়েছে। যুদ্ধের কল্যাণে তখন গন্ডা গন্ডা নতুন নতুন অফিস খোলা হচ্ছে। চাকরি তখন অঢেল।
ঘুষ, ব্ল্যাক মার্কেটিং আর মদ মেয়েমানুষ–সব মিলিয়ে কলকাতায় তখন নরক গুলজার। হাওয়ায় হাওয়ায় ইনফ্লেসনের কোটি টাকা উড়ছে।