কী আবার, তুই আমার শাশুড়ি হবি।
কিন্তু তুই আমার দাদা না?
দাদা না হাতি! তোর বাবার অনেক দূর সম্পর্কের পিসতুতো দাদার শালার আমি যেন কী হই? ওরে বাপ রে, রিলেশানের লাইন খুঁজতে চৌদ্দো পুরুষের মুণ্ডু ঘুরে যাবে। ওই সম্পর্ক কেউ ধরে!
মজা করে সুরমা বলেছিল, বিয়ের পর আমাকে মা বলবে তো? প্রণাম করবে?
মা কেন জ্যাঠাইমা কাকিমা পিসিমা ঠাকুমা–যা ডাকতে বলবি তাই ডাকব। আর প্রণাম? বলিস তো এখনই বাইশটা প্রণাম অ্যাডভান্স করে দিচ্ছি।
থাক, অ্যাডভান্সের দরকার নেই। ওগুলো পাওনা রইল।
অল রাইট। কিন্তু আসল কাজটা ভুলিস না। আমি তোর বিয়ে দিয়েছি, তুই আমার বিয়েটা দিয়ে দে। কিছু করলে তার রিটার্ন দিতে হয়।
তোমার কথা আমার মনে থাকবে।
শুনতে শুনতে অনীতার মনে হচ্ছিল, পায়ের তলায় সিমেন্টের পাকা ফ্লোর ঢেউয়ের মতো দুলে যাচ্ছে। নাক মুখ ঝাঁ ঝাঁ করে যাচ্ছিল।
যাই হোক, সুরমার অ্যাকটিভিটি এর পর কীরকম হয় সেদিকে লক্ষ রেখে গিয়েছিল অনীতা। দুদিন পরে সত্যি সত্যিই অনিমেষকে বিয়ের কথাটা বলেছিল সে। প্রথমটা রাজি হননি অনিমেষ। সেই কদিন প্রচণ্ড অশান্তি গেছে বাড়িতে। প্রথম স্ত্রী মারা গেলেও তাঁরই সন্তান তো অনীতা। কোন বাপ আর জেনেশুনে নিজের মেয়েকে একজন ঘুষখোর মদ্যপ আর নারী-ঘটিত ব্যাপারে গোলমেলে লোকের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু যুবতী দ্বিতীয় স্ত্রীর চাপে এবং জেদে দুর্বল টাইপের অনিমেষকে রাজি হতে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। অন্তত সুরমার মতো স্ত্রীর সঙ্গে এক বাড়িতে থেকে দীর্ঘকাল নিজের আপত্তি টিকিয়ে রাখার মতো সাহস, শক্তি বা অধ্যবসায় তাঁর ছিল না। মনে তাঁর যা-ই থাক, মুখে কিন্তু এ বিয়ের পক্ষে মত দিতে হয়েছিল।
স্ত্রীর কাছে রাজি হবার পরের দিনই অফিস থেকে ঘণ্টা দুয়েকের ছুটি নিয়ে অনীতার কলেজে গিয়েছিলেন অনিমেষ। সুরমা বাড়িতে আছে বলে বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারেনি অনীতা। সে ঠিক করে ফেলেছিল, কলেজ থেকে অনিমেষের অফিসে ফোন করে কোনো একটা জায়গায় তাঁকে আসতে বলবে। ভালোই হয়েছিল, ফোনটা আর করতে হয়নি।
বাবাকে নিয়ে কলেজের খেলার মাঠের একধারে গিয়ে বসেছিল অনীতা। তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছিল, এ তুমি কী করলে বাবা, ওই বাজে লোকটার সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেলে!
অনিমেষ তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে করুণ মুখে বলেছিল, কাঁদিস না মা, কাঁদিস না। কী করব বল, সুরোটা এত প্রেসার দিচ্ছে।
তুমি তো জানো ওই লোকটা কীরকম?
জানি না আবার, এক নম্বর ডিবচ, ঘুষখোর, পাজি। আমার বাড়িতে এই মতলব নিয়ে যে ঢুকবে, কী করে বুঝব!
কিন্তু আমি তো তোমার মেয়ে। আমার জীবনটা তুমি নষ্ট করে দেবে? ওর সঙ্গে বিয়ে হলে আমি মরে যাব বাবা।
এই বিয়ে কিছুতেই হওয়া উচিত না। তোর লাইফ আমি কোনোভাবেই নষ্ট হতে দিতে পারি না। কিন্তু কী করি বল তো?
দুর্বল অসহায় বাবার দিকে তাকিয়ে করুণাই হয়েছে অনীতার। সে বলেছে, আমি একটা বাঁচার রাস্তা ভেবে বার করেছি।
অনিমেষ খুবই উৎসুক হয়ে উঠেছিলেন, কী রে?
তুমি ওদের সামনে না বোলো না। শুধু জোর দিয়ে জানিয়ে দিও আমার এম.এ-টা কমপ্লিট না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে হবে না। এম. এটা হয়ে গেলে স্কুল-কলেজে একটা চাকরি-টাকরি পেয়ে যাবই, তখন আমি হোস্টেলে গিয়ে থাকব। বাড়িতে থেকে ওই লোকটার সঙ্গে আমরা পারব না। কিন্তু হোস্টেলে গেলে ও যদি আমার পিছু নেয় কী করে ঢিট করতে হয় আমি জানি।
সমস্যাটার এত সহজে সমাধান হয়ে যাবে ভাবতে পারেননি অনিমেষ। তাঁর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তিনি বলেছেন, দ্যটস ফাইন, দ্যাটস ফাইন। ওদের আশা দিয়ে দিয়ে রেখে আমাদের কাজ গুছিয়ে নেব। তারপর একটা সত্যিকারের ভালো ছেলে দেখে তোর বিয়ে দেব। বলতে বলতে কী ভেবে তাঁর মুখ হঠাৎ বিষাদে ছেয়ে যেতে শুরু করেছিল। একটু চুপ করে থেকে আবছা গলায় তিনি আবার বলেছিলেন, কিন্তু
কী বাবা?
তুই আমাকে ছেড়ে হোস্টেলে চলে যাবি?
সরল ভালো মানুষ দুর্বল বাবার জন্য খুব কষ্ট হয়েছিল অনীতার। সে বলেছিল, বাড়ির ব্যাপারটা তো তুমি বোঝোই। ওখানে থাকব আর এই বিয়ে হবে না, তাতে অশান্তি শুধু বাড়বেই।
অনীতা কার সম্বন্ধে ইঙ্গিত করেছিল তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি অনিমেষের। বিভিন্ন ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে তিনি বলেছিলেন, ঠিকই বলেছিস মা।
তুমি এখন থেকে আবার মন খারাপ করে থেকো না বাবা। এম.এ-টা পর্যন্ত আমি তো বাড়িতেই থাকছি। হোস্টেলে যাবার পর রোজ তোমার সঙ্গে দেখা করব।
বাবা আর মেয়ে ভবিষ্যতের একটা পরিকল্পনা ঠিক করে নিয়েছিল। বিয়ের ব্যাপারে তারা আপত্তি তো করবেই না, বরং ওপরে ওপরে এমন একটা ভাব দেখাবে যেন বিয়েটা নিতান্তই অবধারিত। কিন্তু ভেতরে ভেতরে নিজেদের কাজ করে যাবে।
অনীতারা একভাবে ভবিষ্যতের প্ল্যান করেছিল। কিন্তু উলটোদিকের ব্যাপারটা সেই মুহূর্তে ভেবে দ্যাখেনি।
অনিমেষ বিয়েতে রাজি হওয়ায় নবকুমারের সাহস দশগুণ বেড়ে গিয়েছিল। অনীতাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভাবতে শুরু করেছিল সে। একবার এলে খুব সহজে নড়তে চাইত না।
এইভাবে বি. এ ফোর্থ ইয়ার পর্যন্ত চলেছিল। তারপর টেস্টের কয়েক দিন বাদে হঠাৎ নবকুমার জেদ ধরল আত্মীয়স্বজনদের ডেকে বিয়ের কথাবার্তা ফাইনাল করে ফেলতে হবে। বাবা আপত্তি করেছিলেন কিন্তু নবকুমার একেবারে নাছোড়। সে বলেছিল, বিয়েটা নাহয় এম. এর পরেই হবে। ব্যবস্থাটা ফাইনাল করে রাখতে অসুবিধাটা কোথায়? সে তো আর বিয়ের জন্য এই মুহূর্তে চাপ দিচ্ছে না। মোট কথা চারদিক থেকে অক্টোপাসের মতো অনীতাকে বেঁধে ফেলতে চাইছিল নবকুমার। দুর্বল ভালোমানুষ বাবা শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। আড়ালে অনীতাকে বলেছেন বিয়েটা যখন হবেই না তখন কথা পাকা হতে অসুবিধা কোথায়? লোক দেখানো একটা অনুষ্ঠান ছাড়া এটা কিছুই না। এতে নবকুমাররা খুশি থাকবে। দুটো-আড়াইটা বছর কোনও রকমে কাটিয়ে দিতে পারলে অনীতা যখন স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে তখন বিয়েটা ভেঙে দিতে আর কতক্ষণ।