নবকুমারকে নিয়ে প্রথম দিকে আদৌ কোনোরকম দুর্ভাবনা ছিল না অনীতার। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর লতায় পাতায় সম্পর্কের ভাই মদ খাক, ঘুষ খাক বা মেয়েদের পিছনে দৌড়ে জীবন ক্ষয় করে ফেলুক তাতে তার কী? তবে এটা ঠিক, লোকটাকে তার ভালো লাগত না। মদ ঘুষ মেয়ে ইত্যাদি মিশিয়ে তার সম্পর্কে মনটা বিরূপ হয়েই থাকত। তবে মুখে কখনো কিছু বলেনি।
নবকুমারও অনীতার ব্যাপারে প্রথম প্রথম খুব একটা সচেতন ছিল না। বহু দূর সম্পর্কের বোনের সৎমেয়ের সঙ্গে দেখা হলে একটু হাসত, দু-একটা কথা বলত। ব্যস, এই পর্যন্ত।
কিন্তু নবকুমারের ব্যাপারে খুব বেশি দিন নিশ্চিন্ত বা উদাসীন থাকা গেল না।
অনীতা যখন বি.এ পড়ছে সেই সময় নবকুমারের নজর এসে পড়ল তার ওপর। অনীতা তখন ফুল-গ্রোন ইয়াং লেডি। নবকুমার আগে আগে সপ্তাহে এক-আধ দিন আসত, তখন থেকে রোজ আসতে শুরু করল। আগে বোন-ভগ্নিপতির সঙ্গে গল্প করত, অনীতা নামে একটা মেয়ে যে এ বাড়িতে আছে সে সম্বন্ধে তার বিশেষ খেয়াল থাকত না। কিন্তু সব ব্যাপারটা একেবারে বদলে গেল।
এখন থেকে এ বাড়িতে ঢুকেই নবকুমার খানিকক্ষণ অন্যমনস্কর মতো সুরমার সঙ্গে গল্প করত কিন্তু তার চোখ দুটো থাকত অনীতার ঘরের দিকে। উসখুস করতে থাকত সে; তারপর একসময় বলেই ফেলত, অনুকে দেখছি না তো
সুরমা বলত, পড়ছে।
যখনই আসি তখনই দেখি পড়ে, ওকে আসতে বলো তো
নবকুমার এলেই যে ডাক পড়বে সেটা কিছুদিনের মধ্যেই জেনে গিয়েছিল অনীতা। সুরমা একবার ডাকলে সে যেত না; চুপচাপ অসীম বিরক্তি নিয়ে বসে থাকত। দু-তিনবার ডাকাডাকির পর দারুণ অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেতে হত। তাকে দেখা মাত্র চোখ দুটো অস্বভাবিক চকচক করতে থাকত। পুরুষের চোখ কখন এভাবে চকচকায়, সেটা বুঝবার মতো বয়স তখন হয়েছে অনীতার। ভেতরে ভেতরে সে কুঁচকে যেত।
নবকুমার হেসে বলত, বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এসো
অনীতা বলত, কী বলবেন বলুন না। আমি পড়া ফেলে এসেছি।
সবসময় এত কী পড়ো? ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলার হবে নাকি?
না, মানে অনার্সের একটা পেপার–
অনীতাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে নবকুমার বলে উঠত, এক ঘণ্টা না পড়লেও তুমি অনার্স পেয়ে যাবে। এসো তো ভেতরে
অনীতা হয়তো আপত্তি করত কিন্তু তার আগেই সুরমা ঝাঁকিয়ে উঠত, এত করে একটা লোক ভেতরে আসতে বলছে তবু তোমার গ্রাহ্য হচ্ছে না। তোমাকে কি পায়ে ধরে সাধতে হবে?
অগত্যা ভেতরে যেতেই হত। এক ঘণ্টা না, রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত অর্থাৎ যতক্ষণ নবকুমার থাকত ততক্ষণ একটানা কত কথা যে বলে যেত।
প্রথম দিকে সুরমার ঘরে ডাকিয়ে নিয়ে যেত নবকুমার। পরে সাহস বেড়ে গিয়েছিল তার; সোজাসুজি অনীতার ঘরে চলে আসত। পড়াশোনার নাম করে তাকে এড়াতে চাইত অনীতা। কোনও দিন পারত, কোনও দিন পারত না। প্রায়ই ভাবত, বাবাকে নবকুমারের কথা বলবে কিন্তু তার আচরণের মধ্যে তখন পর্যন্ত এমন কিছু অশোভনতা ছিল না যা নিয়ে অভিযোগ তোলা যায়। অথচ লোকটাকে সহ্যও করা যাচ্ছিল না। তা ছাড়া আরও ব্যাপার ছিল। লতায় পাতায় হলেও সত্মায়ের ভাই তো; সম্পর্ক ধরলে মামাই দাঁড়ায়। মামা যদি ভাগ্নির ঘরে গল্প করতে ঢোকে, সেটা এমন কোনো দোষবহ ঘটনা নয়। এ নিয়ে বলার বিপদও আছে, নবকুমার সম্পর্কে কোনো ইঙ্গিত দিলে সুরমা নিশ্চয়ই চুপ করে থাকবে না। হইচই আর অশান্তি খুবই অপছন্দ অনীতার। কাজেই সে মুখ বুজে ছিল।
মোটামুটি এভাবেই চলছিল। অনীতা যখন ফোর্থ ইয়ারে উঠল তখন থেকে সাহসটা আরেকটু বাড়ল নবকুমারের। আগে তবু অফিস ছুটির পর সন্ধের দিকে আসত সে; এবার থেকে যখন-তখন উদয় হতে লাগল।
একদিন তার কলেজ কী কারণে যেন বন্ধ ছিল। দুপুরবেলা একটু দেরি করেই স্নান করতে গিয়েছিল অনীতা। বাথরুম থেকে বেরিয়ে সুরমাদের ঘরের পাশে দিয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়েছিল অনীতা। ষড়যন্ত্রকারীদের মতো চাপা গলায় নবকুমার আর সুরমা কী যেন বলাবলি করছে। নবকুমার কখন এসেছে, অনীতা টের পাইনি, খুব সম্ভব সে তখন বাথরুমে ছিল।
এমনিতে গোপনে আড়ি পেতে কারো কথা শোনার মতো অশোভনতা বা কুরুচি অনীতার মধ্যে নেই। কিন্তু নবকুমার আর সুরমার কথার মধ্যে দু-তিনবার নিজের নাম শুনতে পাওয়ায় অনীতার দারুণ কৌতূহল হয়েছিল; কৌতূহলের সঙ্গে এক ধরনের উদ্বেগও। নবকুমার বলছিল, কথাটা অনিমেষবাবুকে বলেছিস?
সুরমা বলেছিল না, এখনও বলিনি। বলার জন্যে সুযোগ খুঁজছি।
সুযোগ খোঁজাখুঁজির কী আছে, স্ট্রেট বলবি। আমিই বলতাম। নেহাত খারাপ দেখায় তাই তোকে রিকোয়েস্ট করছি।
দেখি
একমাস ধরে তো দেখেই আসছিস। তুই যখন পারছিসই না, আমাকেই বলতে হবে দেখছি
আরেকটু অপেক্ষা করো।
ঠিক আছে। কিন্তু এক উইকের বেশি এক সেকেন্ড ওয়েট করব না। অনিমেষবাবুকে বলবি, এ বিয়েতে তার একটা পয়সাও খরচ হবে না। সব এক্সপেন্ডিচার আমার।
এই খরচ না-হওয়ার ব্যাপারটা সুরমাকে খুবই উৎসাহিত করে তুলেছিল। সে বলেছিল, তুমি ভেবো না; আজকালের মধ্যেই আমি বলে ফেলব। কিন্তু বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়েছিল সে।
সুরকুমার দ্বিধান্বিত ভাবটা লক্ষ করে নবকুমার জিগ্যেস করেছিল, কী হল আবার?
অনীতার সঙ্গে বিয়ে হলে তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কী দাঁড়াবে, ভেবেছ?