সুরমা এবং অনিমেষ দুজনেই এই বিয়ের জন্য নবকুমারের কাছে কৃতজ্ঞ। সুরমার কৃতজ্ঞতার কারণটা এইরকম। অনিমেষ তার চাইতে তেইশ-চব্বিশ বছরের বড় হলেও আর ঘরে সতীনের একটি ধেড়ে মেয়ে থাকলেও স্বামী মানুষটি তাঁর চমৎকার। আত্মীয় বাড়িতে পরগাছার মতো বেঁচে থাকার চাইতে নিজের সংসারে মর্যাদা নিয়ে থাকা যে-কোনো মেয়েরই কাম্য। তা ছাড়া অনিমেষের মধ্যে মমত্ববোধ আছে, সহৃদয়তা আছে। তাঁর কাছে এসে জীবনে প্রথম নিরাপত্তা এবং সম্মানের আস্বাদ পেয়েছে সুরমা। যে নবকুমার তাকে এমন একটা সংসারে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে সারা জীবন তার কাছে কেনা হয়ে থাকারই তো কথা।
অনিমেষের কৃতজ্ঞতার কারণ, এই বয়সে কে আর তাঁকে বিয়ে করত! অথচ ঘরে স্ত্রী না থাকলে কে অনীতাকে দেখে। শুধু স্ত্রী না, একটি সুন্দরী তরুণী স্ত্রী-ই জোগাড় করে দিয়েছে নবকুমার। তার কাছে কৃতজ্ঞ না-থেকে পারা যায়।
অনিমেষ মানুষ হিসেবে তুলনাহীন। তবে স্বভাবটা খুবই দুর্বল। মা-মরা-মেয়ের জন্য তাঁর যথেষ্টই মমতা আর সহানুভূতি। কিন্তু যুবতী স্ত্রীকে বেশ ভয়ও করেন। সুরমার সামনে অনীতাকে বেশি স্নেহ বা আদর দেখাতে তিনি সাহস করেন না; পাছে স্ত্রী অসস্তুষ্ট হয়।
সুরমা মানুষ্টা বেশ জটিল ধরনের। লাইফের গোড়ার দিকে যারা খুব দুঃখ পায় বা মা-বাপ হারিয়ে অন্যের আশ্রয়ে থাকে তারা পরে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং মর্যাদা পেলে হয় দারুণ উদার হয়ে যায় নইলে অত্যন্ত স্বার্থপর আর নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। কিন্তু সুরমার বেলা এ নিয়ম খাটেনি। সে না-হতে পেরেছে পুরোপুরি উদার, না সম্পূর্ণ নিষ্ঠুর। উদারতা এবং নিমর্মতা তার চরিত্রে একসঙ্গে মেশানো নেই; বিভিন্ন সময়ে আলাদা আলাদাভাবে এই দুটো ব্যাপার ফুটে উঠেছে।
বিয়ের পর অনিমেষের কাছে এসে স্বামীর আগের পক্ষের মেয়েকে দুহাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিয়েছিল সুরমা। আট-দশ বছরের ছোট অনীতার সঙ্গে তার সম্পর্ক তখন সমবয়সি বন্ধুর মতো। তাকে ছাড়া সেসময়ে কিছুই ভাবতে পারত না সুরমা। বেড়াতে যাবে; অনীতা সঙ্গে থাকা চাই। সিনেমা দেখবে, অনীতা না গেলে চলবে না। তখন স্কুলে উঁচু ক্লাসে পড়ত অনীতা। স্কুলে যাবার আগে নিজের হাতে তার চুলে বিনুনি করে রিবন বেঁধে দিত সুরমা। স্কুল থেকে ফিরলে তাকে খেতে দিয়ে গল্প করত কিংবা সামানের পার্কে তাকে নিয়ে খানিকক্ষণ বেরিয়ে আসত।
সুরমার সহৃদয় ব্যবহার মায়ের মৃত্যুজনিত কষ্ট অনেকখানি জুড়িয়ে দিতে পেরেছিল। কিন্তু নিজের ছেলেপুলে হবার পর সুরমা বদলে যেতে শুরু করেছিল। সৎ ভাইবোনদের নিয়েই তখন সময় কেটে যেত তার; অনীতার দিকে তাকাবার ফুরসত তখন কোথায় সুরমার? আগের মতো আর গল্প করত না সুরমা, সঙ্গে করে বেড়াতে বা সিনেমা দেখতে নিয়ে যেত না। সে কী খাচ্ছে, কখন স্কুলে যাচ্ছে, কখন ফিরছে, সেসব দিকে সুরমার নজর ছিল না। প্রথম প্রথম কষ্ট হত অনীতার, অভিমান হত। পরে ভাবত নতুন ভাই-বোনেরা ছোট ছোট, তাই সুরমা ওদের নিয়েই থাকে। পরে বুঝতে পারছিল এটা ইচ্ছাকৃত। বাপ কিংবা মা-মরা ছেলেমেয়েদের অনুভূতিগুলো সাঙ্ঘাতিক ধারালো। সামান্য অবহেলা বা অনাদর তারা একটুতেই ধরে ফেলতে পারে।
যতদিন পর্যন্ত নিজের ছেলেপুলে হয়নি ততদিন অনীতা সম্পর্কে সুরমা ছিল উদার এবং স্নেহময়ী। কিন্তু সব মানুষেরই স্নেহ এবং উদারতা সম্ভবত একটা বিশেষ বাউন্ডারি পর্যন্ত। মানুষ তার লিমিটেশন পার হতে পারে না। সুরমাও পরেনি। স্বামীর প্রথম পক্ষের মেয়ের চাইতে নিজের ছেলেমেয়েদের সে যে অনেক বেশি ভালোবাসবে, সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু সুরমা অন্যভাবে হিসেব কষেছিল হয়তো। স্বামীর যা কিছু আছে, টাকা-পয়সা, বাড়ি-ঘর, সব নিজের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সমান ভাগে ভাগ করে দিতে হবে অনীতাকে। তা ছাড়া তার বিয়ের প্রশ্ন আছে। তখনও প্রচুর খরচ। এটা তার পক্ষে অসহ্য। স্নেহ তার মধ্যে এত অপর্যাপ্ত ছিল না যা নিজের সন্তানদের দেবার পরও সতীনের মেয়েকে দেওয়া যায়। ক্রমশ নিজেকে এবং নিজের ছেলেমেয়েদের জন্য সে প্রচণ্ড স্বার্থপর হয়ে উঠেছিল।
এদিকে আরও একটা ব্যাপার ঘটেছিল। সুরমার বিয়ের পর থেকেই নবকুমার অনীতাদের বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেছিল। প্রথমত সে অনিমেষের কলিগ, তার ওপর নতুন আত্মীয়। যার জন্য অনিমেষের দ্বিতীয় বিয়ে এবং যার কাছে সুরমা আর অনিমেষ দুজনেই কৃতজ্ঞ, এ বাড়িতে দস্তুরমতো সে একজন ভিআইপি।
প্রথম প্রথম সপ্তাহে এক-আধদিন আসত। বাবা এবং সম্মায়ের কথাবার্তা থেকে নবকুমার সম্পর্কে অস্পষ্ট একটা ধারণা অনীতার তৈরি হয়েছিল। মোটামুটি দু-তিনটে খবর সে পেয়েছিল–এক, অফিসের যে ডিপার্টমেন্টে নবকুমার কাজ করে সেখানে ঘুষের স্কোপ আছে। সুযোগ পেলেই সে ঘুষ খায়। দুই, মেয়েদের সম্পর্কে তার ছোঁকছোঁকানি দোষ আছে। তিন, রীতিমতো মদ্যপানও করে থাকে সে। এসব কথা বেশ গর্বের সঙ্গেই বলতে নবকুমার।
তার নাকি অনেক মেয়ে বন্ধু। এদের নিয়ে গল্প করবার সময় তার চোখ চকচকিয়ে উঠত। কোন মেয়ের সঙ্গে কীভাবে কতরকম কৌশলে সে ভাব জমিয়েছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ রিপোর্ট দিতে দিতে যেন লালা ঝরতে থাকত। এসব গল্প সে করত সুরমার সঙ্গেই বেশি। মাঝে মাঝে অনিমেষও থাকতেন। অনিমেষ দূর সম্পর্কের শ্যালকের চারিত্রিক এই ব্যাপারগুলো হালকাভাবেই নিতেন। মনে করতেন নবকুমার মজা করছে–এ সব ভান। সুরমা হেসে হেসে বলত, তোমাকে নিয়ে পারা যায় না দাদা।