আজ আর কিছু জিগ্যেস কোরো না। পরে একদিন তোমাকে সব বলব।
অবনীনাথ তবু বলেছিলেন, সেদিন তোমার বাবা বলছিলেন, নবকুমার তোমাদের কী রকম যেন আত্মীয় হয়–
হ্যাঁ। আমার মায়ের অনেক দূর সম্পর্কে জেঠতুতো ভাই।
ভদ্রলোকের কাছে তোমার কি কোনো অবলিগেশন আছে?
আজ আর কিছু জানতে চেও না। প্লিজ
অগত্যা আর কিছু জিগ্যেস করেননি অবনীনাথ। তবে নবকুমার সম্পর্কে অদম্য এক কৌতূহল তাঁকে যেন পেয়ে বসেছিল।
মনে আছে সেদিনও নবকুমার ইউনিভার্সিটিতে এসেছিল। অনীতা কিন্তু আগের দুদিনের মতো ক্লাস ফেলে চলে যায়নি।
অবনীনাথ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন, অনীতার ওপর লক্ষ রাখবেন। যদি নবকুমার এসে পড়ে অনীতা কী করে, সেটা দেখাই তার উদ্দেশ্য। তিনি জানতেন কখন অনীতার অফ পিরিয়ড রয়েছে। সেদিন অনীতার ওপর চোখ রাখার জন্য কখনও যা করেন না তা-ই করেছিলেন। প্রথম দিকের পর পর দু-দুটো ক্লাসে তিনি যাননি।
মনে আছে সেদিন আড়াইটেয় নবকুমার ইউনিভার্সিটিতে এসেছিল। তারপর খোঁজাখুঁজি করে আশুতোষ বিল্ডিংয়ে অনীতাকে ধরেছিল। অবনীনাথ অনীতার কাছ থেকে খানিকটা দূরে একটা মোটা পিলারের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি জানতেন, অনীতার কাছাকাছি থাকলেই নবকুমারকে পাওয়া যাবে।
আশুতোষ বিল্ডিংয়ের চওড়া করিডরে তখন বেশি ভিড়। ছেলেমেয়েরা আর প্রফেসররা অনবরত এধার থেকে ওধারে যাওয়া-আসা করছিল। নবকুমার একধারে অনীতাকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বলেছিল, কাল রাত্তিরে তোমাদের বাড়িতে কী বলেছিলাম?
অনীতা বলেছিল, দ্বারাভাঙা বিল্ডিংয়ের সামনের কম্পাউন্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে।
দাঁড়াওনি কেন? কৈফিয়ত চাইবার মতো করে জিগ্যেস করেছিল নবকুমার।
বেপরোয়া ভঙ্গিতে অনীতা বলেছিল, প্রয়োজন মনে করিনি।
খানিকক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে, তারপর বলেছিল, ও, তাই নাকি!
অনীতা উত্তর দেয়নি। নবকুমার আবার বলেছিল, চলো এখন
আমার ক্লাস আছে।
ক্লাস একদিন না করলেও চলবে।
খুব ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস। এটা মিস করলে পরে অসুবিধা হবে।
এম.এ ডিগ্রির কী এমন দরকার? এক্সটা কিছু হাত-পা গজাবে?
সেটা আমার পার্সোনাল ব্যাপার। আমি বুঝব।
তীব্র চাপা গলায় নবকুমার এবার বলেছিল, তোমার ব্যাপারটা চিরকাল তোমার পার্সোনাল থাকবে না। এর মধ্যেও আমারও কিছু মতামত থাকবে। আমার ইচ্ছা নয়, তুমি আর পড়াশোনা কন্টিনিউ করো।
মুখ-চোখ লাল হয়ে উঠেছিল অনীতার। সে বলেছিল, আপনার ইচ্ছায় পৃথিবীতে সব কিছু হবে বলে আপনার ধারণা নাকি?
পৃথিবীর সবার বেলায় না হলেও তোমার বেলায় হবে। বলে একটু থেমে নবকুমার আবার শুরু করেছিল, তর্ক করে সময় ওয়েস্ট করার মনে হয় না। মুডটাই শুধু শুধু নষ্ট করে দিলে। এখন চলো
বললাম তো, ক্লাস আছে।
তুমি তাহলে যাবে না?
না। আরেকটা কথা কী?
আপনি আর কখনও ইউনিভার্সিটিতে আসবেন না।
চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছিল নবকুমারের। চোখ কুঁচকে যাচ্ছিল। সে বলেছিল, ঠিক আছে, তোমার কথাটা আমার মনে থাকবে। চলি-সে চলে গিয়েছিল।
নবকুমার সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যাবার পর অনীতা করিডর ধরে সোজা ডান দিকে চলে গিয়েছিল। তখন আর তার সঙ্গে দেখা করেননি অবনীনাথ।
তবে বাড়ি ফেরার পথে সেদিন অনীতাকে ভয়ানক বিষণ্ণ আর উৎকণ্ঠিত দেখাচ্ছিল। এবং অত্যন্ত অন্যমনস্কও।
অবনীনাথ জিগ্যেস করেছিলেন, কী হয়েছে তোমার?
অনীতা চমকে উঠেছিল।কই, কিছু হয়নি তো।
তাহলে এরকম দেখাচ্ছে কেন?
চোখে-মুখে হাসি ফোটাতে চেষ্টা করেছিল অনীতা, কী রকম আবার দেখবে! যেমন ছিলাম তেমনই তো আছি। অ্যাজ ফ্রেশ অ্যাজ এভার।
ডোন্ট বি ওভার স্মার্ট। আমাকে তুমি ফাঁকি দিতে পারবে না।
কী আশ্চর্য! আমি–
অনীতার কথা শেষ হবার আগেই অবনীনাথ বলে উঠেছিলেন, এক্সকিউজ মি, তোমার ওপর আজ প্রথম থেকেই লুকিয়ে লুকিয়ে লক্ষ রেখেছিলাম। মনে হয়েছিল নবকুমার আজও আসবে। অ্যান্ড হি কেম। দূর থেকে আমি তোমাদের কিছু কিছু কথা শুনেছি।
অনীতা হকচকিয়ে গিয়েছিল। অবনীনাথ আবার বলেছিলেন, লোকটার এতটা সাহস কী করে হয় বুঝতে পারছি না।
অনীতা উত্তর দেয়নি। অবনীনাথ থামেননি, নবকুমার তোমার কাছে কী চায়? সব-সময় তোমার পিছনে ও লেগে আছে কেন?
অনীতা এবারও চুপ করে ছিল।
অবনীনাথ আবার জিগ্যেস করেছিলেন, লোকটা কী টাইপের?
এতক্ষণে বিস্ফোরণের মতো ফেটে পড়েছিল অনীতা, এক নম্বর শয়তান! আমার লাইফ নষ্ট করে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। কী করে যে ওর হাত থেকে মুক্তি পাব, বুঝতে পারছি না।
অনীতা সেদিন বলেছিল পরে আরেকদিন নবকুমারের কথা বলবে। পরে কোনো সময়ের জন্য আর অপেক্ষা করেনি সে, সেদিন বিকেলেই বলে ফেলেছিল। শুধু নবকুমারের কথাই না; তার জীবনের কিছু কিছু কথাও। যা বলেছিল, মোটামুটি এই রকম–
বাবা, মা এবং অনীতাকে নিয়ে ছিল তাদের চোট ফ্যামিলি। অনীতার বয়স যখন বছর তেরো সেই সময় ওর মা মারা যান। তার কিছুদিন বাদে বাবা তাঁর চাইতে তেইশ-চব্বিশ বছরের ছোট এক মহিলাকে বিয়ে করে আনেন। আর বাবার এই দ্বিতীয় বিয়ের ব্যবস্থাটা যে করেছিল সে নবকুমার।
নবকুমার অনীতার বাবা অনিমেষ মুখার্জির অফিসেই কাজ করত; তাঁর জুনিয়র কলিগ। অনীতার সৎমা সুরমার মা-বাবা ছিল না। দুর সম্পর্কের লতার পাতায় আত্মীয় নবকুমারদের বাড়িতে সে ছিল আশ্রিতা। ঘাড় থেকে ওরা তাকে নামাতে চাইছিল। এদিকে তেরো-চোদ্দো বছরের বড় মেয়েসুদ্ধ অনিমেষের পক্ষে স্বাভাবিক একটা বিয়ে হওয়া সম্ভব ছিল না। একজন ঝেড়ে ফেলতে চায়, আরেকজন মাথায় করে ঘরে এনে বসাতে চায়-কাজেই বিয়েটা হয়ে যেতে আদৌ কোনো বেগ পেতে হয়নি নবকুমারদের।