অনীতা এমনিতেই ক্লাস ফাঁকি দিত না। অবনীনাথ উদ্বেগের গলায় জিগ্যেস করেছিলেন, কী ব্যাপার, শরীর-টরীর খারাপ লাগছে?
না।
তোমার তো শেষের দিকে আরও দুটো ক্লাস আছে।
করব না। আচ্ছা চলি। অবনীনাথকে কিছু বলার সময় না দিয়ে চলে গিয়েছিল অনীতা।
পরের দিনও একই ঘটনা। সেকেন্ড পিরিয়ডের পর ক্লাস থেকে বেরিয়ে করিডরে সেদিনও অনীতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন অবনীনাথ। সেদিন অনীতার শেষ দিকে অনেকগুলো ক্লাস ছিল কিন্তু একটাও না-করে অবনীনাথকে তার জন্য অপেক্ষা করতে না-বলে চলে গিয়েছিল। আগের দিনের মতোই তার মধ্যে ছিল অস্থিরতা এবং উদ্বেগ।
পর পর দুদিন এভাবে অনীতার চলে যাবার কারণটা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। সেদিনে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে সন্ধেবেলা অনীতাদের বাড়ি গিয়ে খোঁজখবর নেবেন কিনা ভাবতে ভাবতে দ্বারভাঙা বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি দিয়ে নীচের কম্পাউন্ডে এসে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন অবনীনাথ। সেই নেমন্তন্নর দিন রাত্তিরে লুব্ধ বেড়ালের মতো চকচকে চোখে যে যুবকটি অনীতার দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে বসে ছিল সে চনমন করে কাকে যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। কী যেন নাম তার? অবনীনাথের তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে গিয়েছিলনবকুমার। সে কি কোনো দরকারে এখানে এসেছে, না কারো খোঁজে?
এগিয়ে গিয়ে কথা বলবেন কিনা অবনীনাথ যখন ভাবছিলেন সেই সময় নবকুমার তাকে দেখতে পেয়েছিল। কয়েক সেকেন্ড স্থির চোখে তাকিয়ে তেকে লম্বা লম্বা পা ফেলে কাছে চলে এসেছিল সে। বলেছিল, চিনতে পারছেন?
অবনীনাথ মাথা নেড়েছিলেন। অর্থাৎ পেরেছেন।
ভালো আছেন?
হ্যাঁ। আপনি?
ফাইন।
এখন কি আপনার অফ পিরিয়ড চলছে?
হ্যাঁ–
নবকুমার কথা বলছিল ঠিকই, তবে তার চোখ দুটো চরকির মতো অনবরত চারদিকে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছিল। দুম করে নিজের অজান্তেই হঠাৎ অবনীনাথ বলে ফেলেছিলেন, আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?
কোনোরকম ভণিতা না করে সোজাসুজি পরিষ্কার গলায় নবকুমার বলেছিল, হ্যাঁ। অনীতাকে।
অবনীনাথ এইরকমই ভেবেছিলেন। কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তিনি, তার আগেই কবজি উলটে ঘড়িটা দেখে নবকুমার আবার বলে উঠেছিল, দুটো পাঁচ। ওকে বলেছিলাম ঠিক দুটোয় এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে। স্ট্রেঞ্জ! কালও ছিল না, আজও নেই! বলতে বলতে বিরক্তি এবং রাগে তার ভুরু কুঁচকে যাচ্ছিল।
অবনীনাথ এবার বুঝতে পেরেছিলেন, কেন দুদিন ধরে সবে ক্লাস না-করেই অনীতা চলে যাচ্ছে। এই লোকটাকে স্পষ্টতই সে এড়াতে চাইছিল।
নবকুমার এবার জিগ্যেস করেছিল, অনীতার আর আপনার কি সেম সাবজেক্ট?
অবনীনাথ বলেছিলেন, না। অনীতার হিস্ট্রি, আমার ইংলিশ।
নবকুমার জিগ্যেস করেছিল, অনীতাকে কি আজ ইউনিভার্সিটিতে দেখেছেন?
এক মুহূর্ত না-ভেবে অবনীনাথ বলেছিলেন, দেখেছি। পাঁচ মিনিট আগেই আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে।
নবকুমার এবার কিছুটা অস্থির হয়ে উঠেছিল, কোথায় দেখলেন?
আমার ক্লাসরুমের সামনের করিডরে। দেখা হতেই বলল, চলে যাচ্ছে। আজ আর ক্লাস করবে না।
কোথায় গেল বলতে পারেন?
না।
চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছিল নবকুমারের। দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল, যেখানেই যাও আমার হাতের বাইরে যেতে পারবে না। আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ায়নি নবকুমার। এক মোচড়ে শরীরটাকে দ্রুত ঘুরিয়ে নিয়ে কলেজ স্ট্রিটের দিকে একরকম দৌড়োতেই শুরু করেছিল।
নবকুমার ইচ্ছা করলে অনীতাদের বাড়ি গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে পারত। তবু কেন যে ইউনিভার্সিটিতে এসেছিল মোটেই বোঝা যাচ্ছিল না। নবকুমারের পিছু পিছু কয়েক পা এগিয়ে গিয়েছিলেন অবনীনাথ। ততক্ষণে সে গেট পার হয়ে টাম-রাস্তায় চলে গেছে। ওখানে একটা টু-সিটার পার্ক করা ছিল। সেটায় উঠে ঝড়ের বেগে চালিয়ে দিয়েছিল সে।
ছুটির পর বাড়ি ফিরে একবার অবনীনাথ ভেবেছিলেন, অনীতাদের বাড়ি গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে আসবেন। বার দু-তিনেক রাস্তায় নেমেও ফিরে এসেছেন। আগে কখনও একা একা অনীতাদের বাড়ি যাননি, ভীষণ সংকোচ হচ্ছিল তাঁর। হঠাৎ আসার কারণটা সম্বন্ধে কেউ যদি জিগ্যেস করে, তখন কী উত্তর দেবেন তিনি? মনে মনে অবনীনাথ ঠিক করে ফেলেছিলেন পরের দিন ইউনিভার্সিটিতে যাবার সময় এ নিয়ে অনীতার সঙ্গে কথা বলবেন।
বলেছিলেনও। শুনে অনীতা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকেছে। তারপর মলিন একটু হেসে বলেছে, ও কিছু না।
অবনীনাথ বলেছিলেন, কিছু না হলে ক্লাস না করে দুদিন পালিয়ে বেড়াচ্ছ কেন?
অনীতা চমকে উঠেছিল, কে বললে পালিয়ে বেড়াচ্ছি?
কারো বলার দরকার নেই। এটুকু বুঝবার মতো আমি সাফিসিয়েন্টলি গ্রোন আপ।
দোতলা বাসের ফ্রন্ট সিটে পাশাপাশি বসে যাচ্ছিল ওরা। এবার আর উত্তর দেয়নি অনীতা, বিষণ্ণ চোখে সামনের জানলার বাইরে তাকিয়ে ছিল।
অবনীনাথ বলেছিলেন, কী হল, চুপ করে রইলে যে?
অনীতা মুখ ফেরায়নি। অন্যমনস্কর মতো চৌরঙ্গীর ঝকঝকে রাস্তা দেখতে দেখতে বলেছিল, কী বলব?
তুমি নবকুমারকে ভয় পাচ্ছ কেন?
শুধু শুধু ভয় পাব কেন? অনীতা হাসতে চেষ্টা করেছিল।
অবনীনাথ বলেছিলেন, পাচ্ছ, আর বলছ পাব কেন?
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে অনীতা বলেছিল, ভয় কিনা ঠিক বলতে পারব না। তবে ওকে দেখলে ভীষণ অস্বস্তি হয়। একটু থেমে আবার বলেছিল, কী জানি, হয়তো ভয়ই পাই ওকে।
অবনীনাথ বলেছিলেন, কারণটা কী?