মুখ লাল হয়ে উঠেছিল অবনীনাথের। কিছু একটা উত্তর দিতে চেষ্টা করেছিলেন অবনীনাথ, গলার স্বর ফোটেনি। এই সময় বাস এসে গিয়েছিল। ওপরে উঠেই অনীতার খেয়াল হয়েছিল, অবনীনাথ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। বলেছিল, কী হল, উঠে পড়ুন, এক্ষুনি বাস ছেড়ে দেবে।
অনীতার সঙ্গে যাবার ইচ্ছা ছিল না অবনীনাথের। তিনি ওঠেননি। অনীতার কথার উত্তর না দিয়ে তিনি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। এদিকে ঘন্টি দিয়ে বাস ছেড়ে দিয়েছিল। ফুটবোর্ড থেকে অনীতা চেঁচিয়ে উঠেছিল, উঠুন, তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন। চলন্ত বাস থেকে কোনো মেয়ের লাফ দিয়ে নামা অসম্ভব। পারলে হয়তো সে নেমেই পড়ত।
মিনিট দশেক বাদে আবার একটা দোতলা বাস এসে গিয়েছিল। অবনীনাথ সিঁড়ি দিয়ে সোজা ওপরে উঠে সামনের দিকের সিটে বসে পড়েছিলেন।
দুপুরবেলায় আপ এবং ডাউন দুদিকের কোনো বাসেই ভিড়-টিড থাকত না তখন। ওপরটা বেশ ফাঁকাই, দু-চারটে লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে ছিল।
কয়েকটা স্টপেজ পার হয়ে বাসটা ময়দানের কাছে আসতেই আচমকা ঠিক পিছন থেকে মেয়েলি গলা ভেসে এসেছিল, একটু শুনুন–
চমকে ঘাড় ফেরাতেই অবনীনাথ দেখতে পেয়েছিলেন, অনীতা ঠিক তাঁর পিছনের সিটটায় বসে আছে। চোখাচোখি হতেই অবাক অবনীনাথ বলেছিলেন, আপনি এ বাসে এলেন কী করে?
অনীতার চোখে-মুখে ঠাট্টা বা রগডের লেশমাত্র ছিল না। আস্তে আস্তে সে বলেছিল, আগের বাসটায় দুটো স্টপেজ গিয়েই নেমে পড়েছিলাম। জানতাম আপনি নেক্সট বাসটায় আসবেন। এ বাসটা আসতেই উঠে পড়লাম।
অবনীনাথ বুঝতে পারছিলেন না, তাঁর পিছনে ভালো করে লাগবার জন্যই অনীতা আগের বাসটা থেকে নেমে পড়েছে কিনা। তিনি আর কিছু বলতে পারেননি।
অনীতা এবার বলেছিল, আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।
অবনীনাথ হকচকিয়ে গিয়েছিলেন, ক্ষমা ক্ষমা কীসের?
সেদিন ইউনিভার্সিটিতে আলাপ হবার পর যে কবার আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে খারাপ ব্যবহার করেছি। এটা করা আমার উচিত হয়নি।
ঠিক আছে, ঠিক আছে–
অনীতা বলে গিয়েছিল, তবে একটা কথা বলতে পারি, আমার মধ্যে কোনো ম্যালিস ছিল না বা এখনও নেই। যা করেছি শুধু মজা করবার জন্যেই। আপনাকেই সত্যি হার্ট করতে চাইনি। কিন্তু বুঝতে পারছি ব্যাপারটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। প্লিজ, মনে কিছু করবেন না।
অনীতার কথাগুলো খুবই আন্তরিক মনে হয়েছিল অবনীনাথের। আস্তে করে বলেছিলেন, ঠিক আছে, মনে কিছু করব না।
অনীতা তক্ষুণি আর কিছু বলেনি। জানলার বাইরে চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। তারপর আবছা গলায় বলেছিল, এমনিতে ভালো লাগে না, লোকের সঙ্গে মজা-টজা করে যতক্ষণ অন্যমনস্ক থাকা যায় আর কী।
আর আচমকা তখনই মামা বা মামির কথা মনে পড়ে গিয়েছিল অবনীনাথের। অনীতাটা বড় দুঃখী।
যাই হোক, সেদিনের পর অনীতা তাকে নিয়ে আর মজা-টজা করেনি।
এদিকে ক্লাস পুরোদমে শুরু হয়ে গিয়েছিল। অনীতা এবং অবনীনাথের সাবজেক্ট এক না। দুজনের ক্লাসও সব দিন এক সময় শুরু হত না। যেদিন হত সেদিন বাস রাস্তায় অনীতার সঙ্গে দেখা হত। দোতলা বাসে পাশাপাশি বসে দুজনে ইউনিভার্সিটিতে চলে যেতেন।
মাঝে মধ্যে বাস স্টপেজেই শুধু দেখা হত না। দু-একদিন পর পর হঠাৎ হঠাৎ মামাদের বাড়িতে চলে আসত অনীতা। তা ছাড়া ইউনিভার্সিটিতে তো প্রায় রোজই দেখা হত।
পোশাকে এবং চেহারাতেই শুধু না, চালচলন কথাবার্তা–সব কিছুর ওপরেই দ্রুত শহুরে পালিশ পড়তে শুরু করেছিল অবনীনাথের প্রথম দিকের সেই আড়ষ্টতা আর ছিল না।
অনীতার সঙ্গে দেখা হলে আগে গুটিয়ে যেতেন অবনীনাথ। কিন্তু মাসখানেকের ভেতর ব্যাপারটা বদলে গেল। অনীতাকে দেখলে হাসতেন, কখনও নিজের থেকে এগিয়ে গিয়ে কথাটথা বলতেন। আস্তে আস্তে এমন হল, একই সময়ে ক্লাস শুরু না হলেও ওঁরা একসঙ্গেই ইউনিভার্সিটিতে যেতেন। যার আগে ক্লাস থাকত, তিনি অন্যকে সময়টা বলে দিতেন। সেই অনুযায়ী আরেকজন বাস স্টপেজে গিয়ে দাঁড়াত। ক্লাস ছুটির পর আগে যে যার মতো বাড়ি ফিরতেন। পরে যাঁর আগে ছুটি হত তিনি অন্যের জন্য অপেক্ষা করতেন। এর মধ্যে পরস্পরকে কবে যে ওরা তুমি-টুমি করে বলতে শুরু করেছিলেন, কে জানে! এত সব কীভাবে সম্ভব হয়েছিল, এত কাল বাদে আর মনেও পড়ে না।
সেক্সান আরম্ভের মাসখানেক কি মাস দুয়েক বাদে হঠাৎ একটা ব্যাপার ঘটল। পর পর তিনটে ক্লাসের পর সেদিন দুটো পিরিয়ড অফ ছিল অবনীনাথের। তারপর আবার একটা ক্লাস হয়ে ছুটি। অবনীনাথ জানতেন, অনীতার প্রথম দিকে দুটো পিরিয়ডের পর তিন পিরিয়ড অফ; তারপর দুটো ক্লাস আছে। আগে থেকে ঠিক করা ছিল, অনীতার ছুটি হলেই একসঙ্গে দুজনে বাড়ি ফিরবেন।
যাই হোক, পর পর তিনটে পিরিয়ড করে ক্লাস থেকে বেরুতেই অবনীনাথের চোখে পড়েছিল দরজার সামনের করিডরে দাঁড়িয়ে আছে অনীতা।
দুজনেরই অফ পিরিয়ড থাকলে কেউ কারো ক্লাসের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন না। নীচে দ্বারভাঙা বিল্ডিংয়ের সামনে কম্পাউন্ডে বা সেনেট হলে লম্বা লম্বা সিঁড়িতে গিয়ে বসতেন। বা হেঁটে হেঁটে গল্প করতেন। কাজেই অনীতাকে ওখানে দেখে অবনীনাথ বেশ অবাকই হয়ে গিয়েছিলেন। কেমন যেন অস্থির আর অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল তাকে। অবনীনাথ কিছু বলার আগেই অনীতা কাছে এগিয়ে এসেছিল, তোমার সঙ্গে আজ ফিরতে পারব না। আমি এখন যাচ্ছি।