অবনীনাথ অন্য কথা ভাবছিলেন। তাই মামা-মামির কথাবার্তা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলেন না। দুরমনস্কর মতো তিনি বলেছিলেন, একটা ব্যাপারে খুব অবাক হয়ে যাচ্ছি মামা–
মামা জিগ্যেস করেছিলেন, কী রে?
অনীতার মায়ের বয়স একেবারে বোঝা যায় না?
কত বয়স বলে তোর মনে হয়?
কত আর, ত্রিশ-বত্রিশ-
মহিলার বয়স একজাক্টলি তা-ই।
কিছুক্ষণ অবাক হয়ে ছিলেন অবনীনাথ। তারপর বলেছিলেন, অত বড় মেয়ে যাঁর
মামা বলেছিলেন, সত্যি, তুই একটা যা-তা। এতটুকু বুদ্ধিসুদ্ধি হল না। এতটা বয়স পর্যন্ত শুধু বই মুখস্থ করেই গেলি।
কী বলবেন বুঝতে পারেননি অবনীনাথ। বিমূঢ়ের মতো শুধু মামার দিকে তাকিয়ে থেকেছেন।
মামা এবার মজা করে বলেছেন, তোর কি ধারণা, বত্রিশ বছরের মহিলার বাইশ-তেইশ বছরের একটা মেয়ে থাকতে পারে?
তা হলে উনি–এই পর্যন্ত বলে এবার থেমে গিয়েছিলেন অবনীনাথ।
মামা বলেছিলেন, আরে বোকা, ওটা ওর সত্যা।
ব্যাপারটা অনেক আগেই তাঁর মাথায় আসা উচিত ছিল। সে আমলে যৌবনের অনেকখানি সময় পর্যন্ত কী আশ্চর্য সরল, নাকি বোকা-ই ছিলেন তিনি!
সৎমা শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল অবীনাথের। হয়তো ওই মহিলাটি ভালো, স্নেহপ্রবণ তবু সত্মার সঙ্গে কী যেন এক দুঃখ জড়িয়ে আছে। অবনীনাথ আর কিছু বলেননি।
ওদিকে মামা আর মামি নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছিলেন।
মামি বলছিলেন, দেখলে তো, নবকুমারটা আবার আসা-যাওয়া শুরু করেছে। অনুর বাবা ওকে বাড়িতে ঢুকতে বারণ করে দিয়েছিল?
মামা বলেছিলেন, কী করবে! বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্ষা। স্ত্রী যাকে সাপোর্ট দিচ্ছে তাকে কতক্ষণ ঠেকিয়ে রাখবে! অনুটার জন্যে বড় দুঃখ হয়।
আর আগেও অনুর সম্পর্কে দুঃখী বা দুঃখ শব্দটা কানে এসেছে অবনীনাথের। কেন মেয়েটা দুঃখী বা কীসের তার দুঃখ, এসব কথা জিগ্যেস করতে গিয়েও পারেননি। অনীতার ব্যাপারে অকারণ আগ্রহ বা কৌতূহল দেখালে মামা-মামি কিছু বলতে পারেন। তবু নিজের অজান্তে বলে ফেলেছিলেন, ওই নবকুমার দত্ত লোকটা কে?
মামা উত্তেজিত মুখে বলেছিলেন, একটা আস্ত রাসকেল। পায়ের তলা থেকে চুলের ডগা পর্যন্ত একটি প্রথম শ্রেণীর শুয়ারের বাচ্চা। বদ, লুচ্চা, হারামজাদা-কলকাতায় আসার পর মামাকে এরকম খিস্তি এবং উত্তেজিত হতে দ্যাখেননি অবনীনাথ। ভদ্র বিনয়ী আমুদে এবং হৃদয়বান মামার এভাবে খেপে ওঠার নিশ্চয়ই কারণ আছে কিন্তু তা জিগ্যেস করা যায়নি।
এদিকে মামা অনবরত নবকুমার সম্পর্কে খারাপ খারাপ কথা বলে গিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলেটা কেন খারাপ সে সম্পর্কে কিছুই বলেনি। তবে অনীতার ব্যাপারে মনটা ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল।
বাড়ি ফিরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ ঘুমোতে পানেননি অবনীনাথ। বার বার অনীতার মুখটা আর তার গাওয়া রবীন্দ্রনাথের একটা গানের কলি দীপ নিভে গেছে মম-ঘুরে ঘুরে মনের ভেতর ছায়া ফেলে যাচ্ছিল।
মামার বাড়িতে আসার পর অবনীনাথের একটা বড় কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল একা একা অলিগলি বা বড় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কলকাতাকে চেনা। দিন দশ-বারো ঘোরাঘুরির পর এই সুবিপুল শহর সম্পর্কে খানিকটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে যে রাস্তাটা দিয়ে ইউনিভার্সিটি যাওয়া যায় সেটা দিয়ে দিনে চার-পাঁচ বার যাতায়াত করে সড়গড় করে নিয়েছিলেন।
দেখতে দেখতে ইউনিভার্সিটির সেশান শুরু হয়ে গিয়েছিল।
মনে পড়ে প্রথম দিন ক্লাস ছিল দেড়টায়। দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার পর মামার দেওয়া শার্ট টাউজার্স পরে বড় রাস্তায় বাস স্টপজে এসে দাঁড়িয়েছিলেন অবনীনাথ। দোতলা বাস এলেই উঠে পড়বেন। কিন্তু বাস আসার আগেই অনীতা এসে গিয়েছিল। তাকে দেখামাত্র নানা ধরনের ঢেউ অবনীনাথের মনের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল। প্রথমত, তার সক্সার মুখ মনে পড়েছে, সেই সঙ্গে মামা-মামির বলা দুঃখী শব্দা। দ্বিতীয়ত, যা মনে হয়েছে অবনীনাথের পক্ষে তা খুবই অস্বস্তিকর। তাঁর সঙ্গে চোখাচোখি হলেই অনীতা এমন সব ঠাট্টা-টাট্টা বা রগড় করে যাতে লজ্জায় মাথা তুলতে পারেন না অবনীনাথ।
একটু হেসে কাছে এগিয়ে এসেছিল অনীতা। বলেছিল, আজ থেকে আপনারও ক্লাস আরম্ভ হল বুঝি?
অবনীনাথ বলেছিলেন, হ্যাঁ।
আমারও। বলে একটু থেমে অনীতা আবার আরম্ভ করেছিল, আপনাদের বাড়ি হয়ে এলাম। শুনলাম, বেরিয়ে পড়েছেন। কদিনে আপনার খুব ইমপ্রুভমেন্ট হয়েছে। এখন আর কারো হেল্প আপনার দরকার নেই।
অনীতার গলায় সেই রগড়ের সুর। অবনীনাথের ব্রিবত মুখে বলেছিলেন, না, মানে~~~
অনীতা ফের বলেছিল, স্বাবলম্বনের চাইতে বড় কোয়ালিটি আর কিছু নেই। ভেরি গুড। তবে বলে পায়ের নুতন চঞ্চল থেকে চুলের ছাঁট পর্যন্ত চোখ কুঁচকে বার বার দেখে যাচ্ছিল সে।
নিজেকে ভেতরে ভেতরে গুটিয়ে নিতে নিতে ভয়ে ভয়ে অবনীনাথ জিগ্যেস করেছিলেন, কী দেখছেন?
আপনাকে দেখতে দেখতে বঙ্কিমচন্দ্রের সেই কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছে মা কী ছিলেন, আর কী হইয়াছেন–
অনীতার আক্রমণটা কোন দিক থেকে আসছে তার কিছুটা বুঝতে পারছিলেন অবনীনাথ, সেই কারণে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন।
অনীতা বলে যাচ্ছিল, একটা দারুণ ব্যাপার মিস করে ফেললাম। সেদিন ইউভার্সিটিতে আপনাকে যে ড্রেসে দেখেছিলাম তার একটা ফটো তুলে রাখা উচিত ছিল আর এখনকার একটা ফটো। চেঞ্জটা কতখানি হয়েছে তার একটা কম্পারেটিভ স্টাডি করা যেত।