- বইয়ের নামঃ সমাপ্তি
- লেখকের নামঃ প্রফুল্ল রায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. বিরাট ড্রইং রুম
সমাপ্তি – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়
০১.
দোতলার এই বিরাট ড্রইং রুমটা চমৎকার সাজানো। সোফা, সেন্টার টেবিল, জয়পুরী কার্পেট, টিভি, মেরুন রঙের টেলিফোন, বিদরির কাজ-করা ফ্লাওয়ার ভাস–সেখানে যেটি থাকলে সবচাইতে ভালো দেখায় ঠিক সেখানেই সেটি রয়েছে। দরজায় কিংবা জানলায় ঝুলছে দামি পর্দা।
আজ রবিবার। দুপুর পার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। ছুটির দিনের এই বিকেলে ড্রইং রুমে সবাই শ্বাসরুদ্ধের মতো অপেক্ষা করছিল। অবনীনাথ ঘরে এসে ঢুকলেন। তাঁর এখন একষট্টি চলছে। এই কমাস আগে গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে রিটায়ার করেছেন।
ছফুটের মতো হাইট অবনীনাথের। এই বয়সেও মেরুদণ্ড সটান। চওড়া কপাল। পাতলা চুলের বেশির ভাগই রুপোর তার হয়ে গেছে। লম্বাটে মুখ তাঁর, দৃঢ় চিবুক, ধারালো নাক। গায়ের রং ফর্সাও না, কালোও না–দুইয়ের মাঝামাঝি। তবে ত্বক শিথিল হতে শুরু করেছে, লক্ষ করলে কপালে সরু সরু অগুনতি রেখা চোখে পড়ে। এটুকু ছাড়া সময় বা বয়স তাঁর শরীরে আর কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি। মোটা ফ্রেমের বাইফোকাল লেন্সের ওপারে চোখে দুটি কিন্তু এখনও তাঁর ভারী উজ্জ্বল।
অবনীনাথের পরনে পাতলা ধবধবে পাজামা এবং পাঞ্জাবি। এখন জানুয়ারি মাসের শেষাশেষি। হু হু করে শীতের উলটোপালটা হাওয়া বইছে। তাই পাঞ্জাবির ওপর কাশ্মীরি শাল।
অবনীনাথ খুব ধীরে ধীরে সবাইকে একবার দেখে নিলেন। বড় ছেলে অভীক এবং তার গুজরাটি স্ত্রী মৃদুলা বাঁদিকে বসে আছে। অভীকের বয়স একত্রিশ-বত্রিশ। দারুণ সুপুরুষ চেহারা। তার দিকে তাকালে নিজের তরুণ বয়সের কথা মনে পড়ে যায় অবনীনাথের। তাঁর পুরো ছাঁচটাই বসানো রয়েছে ওর চেহারায়। তাঁর মতোই দুর্দান্ত ছাত্র ছিল অভীক। আপাতত আছে ফরেন সার্ভিসে। প্যারিসে ইন্ডিয়ান এমব্যাসিতে অভীক ফার্স্ট সেক্রেটারি। ওর স্ত্রী মৃদুলাও ভালো ছাত্রী। দেখতেও চমৎকার। ওরা কলকাতায় পঞ্চাশ বছর ধরে ডামিসাইড। মৃদুলা এবং অভীক একসঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজ আর ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। পড়তে পড়তেই প্রেম; তারপর অভীক ফরেন সার্ভিসে ঢোকার পর বিয়ে। ওদের এক ছেলে, এক মেয়ে।
অভীকদের পরে বসে আছে বড় মেয়ে সুদীপা এবং তার স্বামী মৃন্ময়। সুদীপার বয়স আঠাশ; খুবই সুশ্রী চেহারা। ইকনমিসে পি এইচ ডি করেছে। ওর স্বামী মৃন্ময় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ওরা থাকে রাঁচিতে। ওখানকার একটা মাটিন্যাশনাল কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে মৃন্ময় ওয়াকর্স ম্যানেজার। সুদীপা একটা গার্লস কলেজে পড়ায়। ওদের দুই মেয়ে।
আরেক দিকে বসে আছে ছোট ছেলে অঞ্জন এবং তার স্ত্রী চৈতী। অঞ্জন অবনীনাথের মতো হাইট বা চেহারা পায়নি। ও তার মায়ের মতো। মাঝারি উচ্চতা, গোলগাল মুখ, ঈষৎ মোটা নাক। তবে স্বাস্থ্য বেশ ভালো। বিজনেস ম্যানেজমেন্টে ডিগ্রি নিয়ে অঞ্জন বম্বের একটা ফার্মে এখন টপ একজিকিউটিভ। ওর স্ত্রী চৈতী হাসি-খুশি আদুরে ধরনের মেয়ে। বাংলায় মোটামুটি এম.এ-টা পাশ করে গেছে। ছাত্রী ব্রাইট না হলেও গানের গলা তার অসাধারণ, আকাশবাণীর বম্বে সেন্টার থেকে রেগুলার হিন্দুস্থানি ক্লাসিক গায়। ওদের একটা মেয়ে।
অঞ্জনদের পর বসেছে ছোট মেয়ে রঞ্জনা এবং তার স্বামী চিরদীপ। রঞ্জনার বয়স তেইশ। ও আবার অবনীনাথের চেহারা পেয়েছে। এবছর যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে কম্প্যারাটিভ লিটারেচারে এম.এ পাশ করেছে। আর চিরদীপ কলকাতায় একটা বড় কলেজে ফিজিক্স পড়ায়। এখন থেকে ঠিক তিন মাস আগে ওদের বিয়ে হয়েছে।
দুই ছেলে, দুই পুত্রবধূ, দুই মেয়ে এবং তাদের স্বামীরা ছাড়া আর কেউ নেই। এমনকী নাতি নাতনিদেরও দুঘণ্টার জন্য এ ঘরে প্রবেশ নিষেধ।
অবনীনাথ নিজে আজকের এই পারিবারিক সভার আয়োজন করেছেন। নিজের ছেলেমেয়ে এবং তাদের স্ত্রী বা স্বামীরা ছাড়া আর কেউ যাতে এখানে না থাকে, আগে থেকেই সবাইকে তা বলে দিয়েছেন।
ছোট মেয়ে রঞ্জনার বিয়ের পর থেকে এ রকম একটা পারিবারিক কনফারেন্সের কথা ভেবে আসছিলেন অবনীনাথ কিন্তু ছেলেমেয়েদের সবাইকে একসঙ্গে পাওয়া যাচ্ছিল না। হঠাৎ দিন তিনেক আগে এক্সটার্নাল মিনিস্ট্রির কী একটা জরুরি দরকারে দিল্লিতে এসেছিল অভীক, এসেই অবনীনাথকে ফোন করেছিল। অভীককে পাওয়াই ছিল সবচাইতে বড় প্রবলেম। ফরেন সারভিসের কাজে ইন্ডিয়ার বাইরে যাদের থাকতে হয় তাদের পক্ষে ইচ্ছা করলেই হুটহাট দেশে ফেরা সম্ভব না।
অভীকের ফোন পেয়েই অবনীনাথ স্থির করে ফেলেছিলেন, এই সুযোগ ছাড়া ঠিক হবে না। তিনি মনে মনে যা ভেবে রেখেছেন তার জন্য ছেলেমেয়ে পুত্রবধু এবং জামাইদের প্রত্যেককে প্রয়োজন। এদের কাউকেই বাদ দেওয়া সম্ভব হবে না। অন্যদের সবাইকে ইচ্ছা করলে পাওয়া গেলেও অভীককে নিয়েই ছিল সমস্যা। যাই হোক, হঠাৎ তার ফোন পেয়ে খুশিই হয়েছিলেন অবনীনাথ এবং কদিনের জন্য কলকাতায় ঘুরে যেতে বলেছিলেন। অভীক বলেছিল, এবার কলকাতায় যাওয়ার অসুবিধা আছে। অবনীনাথ কোনো কথা শোনেননি। এমনিতেই কারো ওপরেই তিনি কখনও কোনো ব্যাপারেই চাপ দেন না কিন্তু জীবনে এই বোধ হয় দ্বিতীয় কি তৃতীয় বার জোর খাটালেন। তিনি বলেছিলেন, যত অসুবিধাই থাক অন্তত দুদিনের জন্য অভীককে কলকাতায় আসতেই হবে। কাল রাতের ফ্লাইটে ওরা দিল্লি থেকে কলকাতায় এসেছে; এখান থেকেই কাল দুপুরের ফ্লাইটে লন্ডন হয়ে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্লেনে প্যারিস চলে যাবে।