ডরপোক। বিদ্রুপে পুরু পুরু কালো ঠোঁট দুটো বেঁকে গেল লখাইর। নিরোম দ্রুর তলায় হিংস্র চোখজোড়া কোঁচকাল। লখাই গর্জে উঠল, কুত্তা কঁহাকা, ভাগ এখান থেকে। আমার পাশে বসে মাগীদের মত ফাঁচফাঁচ করতে পারবি না।
বলতে বলতে মঙ চোর কাঁধ ধরে প্রবল ঝকানি দিল লখাই। আবার বলল, কাদলে অ্যায়সা কুনুই হাঁকাব—
মঙ চো কী বুঝল, সে-ই জানে। একবার লখাইর দিকে তাকাল। কাল জাহাজ ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে নিদারুণ কান্না জুড়েছে। এখনও থামে নি। পুরা একদিন সে কিছু খায় নি, শোয় নি, সমানে কাঁদছে। চোখ দুটো ফুলে উঠেছে।
মঙ চোর ফোলা ফোলা কুতকুতে চোখে কাতর দৃষ্টি ফুটল। তার পরই দুহাতে মুখ ঢাকল সে। আর শব্দ করল না। শুধু শরীরটা থরথর কাঁপতে লাগল।
মঙ চোর দিকে থেকে দৃষ্টিটা সরিয়ে অনেক উঁচুতে তুলল লখাই। আশ্চর্য! একটা সাদা সাগরপাখি মাস্তুলের ডগায় বসে রয়েছে।
লখাই রুক্ষ স্বরে গজগজ করে, খালি ডর আর ডর। অতই যদি ডরাস, তবে কালা পানি যেতে চেয়েছিলি কেন রে হারামীর বাচ্চারা! আই–
একটু থামে লখাই। আবার শুরু হয়, সমুদুর দেখেই মড়াকান্না লাগিয়েছিস! শালা আন্দামানে নেমে যে দম ফেটে খতম হয়ে যাবি। বিশ সাল ঘানি ঘোরাবি কেমন করে!
সময় কাটতে থাকে, রোদের তেজ বাড়ে। মাস্তুলের ডগায় সাগরপাখিটা যেন ঝলসে যাচ্ছে।
এবার মঙ চোর কাঁধে হাত রাখে লখাই। নরম গলায় বলে, কাঁদবিই যদি, তবে খুন করেছিলি কেন? জানিস না, খুন করলে হয় কঁসি, নয় কালা পানি। ওই সব কঁদুনি ভুলে যা মঙ চো। আন্দামান হল জাহান্নাম জায়গা। সেখানে কার কাছে কাঁদবি মানিক? ঘরের মাগ আছে সেখানে?
আরো অনেকটা সময় কাটে। কেউ আর কিছু বলে না। রোদের রং হলদে হয়ে আসে।
একসময় তোরাব বলে ওঠে, তার গলাটা বড় করুণ শোনায়, লখাই ভাই, তা হলে আমরাদ্বীপান্তরেই চললাম!
ভারী গলায় লখাই বলে, হাঁ রে, হাঁ। যাচ্ছিস আর মালুম পাচ্ছিস না?
শালার দিলটা জবর খারাপ হয়ে গেছে। লখাইর দিকে তাকিয়ে হাসবার চেষ্টা করে তোরাব। চোখ দুটো সামান্য চিকচিক করে।
লখাই বলে, কী হল আবার?
বিবির কথা মনে পড়ছে। ভাঙাভাঙা, অদ্ভুত গলায় তোরাব বলতে থাকে, বিবির পেটে ছানা রয়েছে। আসার সময় জাহাজঘাটে খুব একচোট কাদল সে, বলল। ছেলে জন্মে কুনোদিন তার বাপজানের মুখ দেখতে পাবে না। একটু ছেদ, তারপর বলে, ঠিকই বলেছে বিবি, আন্দামান থেকে আর কুনোদিন ফিরতে হবে না। আর ছেলেও শালা বাপজনের মুখ দেখবে না।
লখাই জবাব দেয় না। খুনখারাপি, রাহাজানি–দুনিয়ার সব রকম ভীষণতার সঙ্গে তার পরিচয় আছে। লালসা, মত্ততা–এগুলির মহিমা সে পুরোপুরি বোঝে। কিন্তু বিষাদে মন যখন নরম হয়, তার মুখে উপযুক্ত জবাব যোগায় না।
তোরাব আবার বলে, দিলটা গোরস্থান হয়ে গেছে। কিছুই ভাল লাগে না। খেয়ে শুয়ে বসে জুত পাই না। খালি বিবির পেটের ছানাটার কথা ভাবি।
লখাইর গলাটা বিষণ্ণ শোনায়, আন্দামান যাচ্ছিস তোরাব। ঘর-সংসার বিবি-বাচ্চার কথা ভুলে যা। যত ভাববি, দিল তত বিগড়োবে।
ভুলতেই তো চাই। কিন্তুক খোদা কি ভুলতে দেবে? কোতল করেছি–হিসেব করে গুনাহর সাজা দেবে না? একটু থামে তোরাব। বড় বড় শ্বাস টানে। অল্প অল্প হাঁপায়। তারপর বলে, দরিয়ার এ-পারে থাকবে বিবি, অনেক ফারাকে দরিয়ার ও-পারে থাকব। আমি। খোদার ইচ্ছা, দিনরাত বিবির কথা ভাবিয়ে ভাবিয়ে আমাকে খতম করবে।
এবার লখাই উত্তর দেয় না। স্থির দৃষ্টিতে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। তার চোখের পাতা পড়ে না।
তোরাব বলে, কী করি বল দিকি লখাই ভাই? বিবির কথা ছেলের কথা ভেবে কুননা কালে তত দিলটা এমন বিগড়ে যেত না!
বড় করুণ দেখায় তোরাবকে। তার কদাকার মুখখানা এই মুহূর্তে তত খারাপ মনে হয় না।
দিলকে ফুর্তি দেওয়ার মতো একটি মাত্র অমোঘ প্রক্রিয়ার কথাই জানা আছে লখাইর। ভড়ে ঊড়ে নির্জলা তাড়ি গিলে, ভাড়া-করা কোনো মেয়েমানুষের ঘরে উন্মত্ত রাত্রি কাটানো। তাড়ির উগ্র ঝাঁঝাল স্বাদে এবং তীব্র উত্তেজক নারীমাংসে যে মৌতাত জমে, তাতে ঝুঁদ হয়ে থাকলে বিগড়ানো দিল আপনিই চাঙ্গা হয়ে ওঠে। আন্দামানগামী এই জাহাজে ওই বস্তু দু’টি নেহাতই নাগালের বাইরে। তা ছাড়া, হাঠাৎই লখাইর মনে হয়, দুনিয়ার সব মন-খারাপের প্রতিকার বোধ হয় নেশায় এবং নারীমাংসে নেই।
বলি বলি করেও দিলকে ফুর্তি দেবার মতো অমোঘ উপায়টার কথা তোরাবকে বলতে পারে না। অদ্ভুত বিষাদে মনটা ভরে যায়। উদাস চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে লখাই।
তোরাব ডাকে, লখাই ভাই–
আচমকা লখাই খেঁকিয়ে ওঠে, চুপ মার। সেই থেকে ঘ্যানঘ্যান লাগিয়েছে! শালা যেন একাই বিবি ছেড়ে এসেছে–
বঙ্গোপসাগরের ঢেউ ফুঁড়ে খুঁড়ে জাহাজ ছোটে। বিপুল সমুদ্র পেরিয়ে কবে যে আন্দামানের কূল মিলবে, কে জানে।
তিনটে কয়েদি চার নম্বর হ্যাচের ওপর নির্বাক, নিস্পন্দ বসে থাকে।