আজ আর পারাপার নেই, দিকচিহ্ন নেই। ভরসা দেওয়ার মতো আকাশের কোথাও একটা সিন্ধু-শকুনকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কালকের চেনাজানা তীর, গৈরিক জলের নদী, কালকের আকাশ বাতাস আজ নেই, কোথাও নেই।
বিশাল সমুদ্র এখানে গর্জায়, গহীন সমুদ্র এখানে অবিরাম ফেঁসে। পাহাড়প্রমাণ তরঙ্গ মালা ফুলে ফুলে যেদিকে আকাশ আর সমুদ্র একাকার হয়ে মিশেছে, বিচিত্র আক্রোশে সেদিকে ধাওয়া করে।
ওপরে অবাধ আকাশ, নিচে অবারিত নোনা সমুদ্র। আকাশ আর সমুদ্র এখানে পাল্লা দিয়ে দিগ্বিদিকে ছোটে।
এর নাম বঙ্গোপসাগর।
বঙ্গোপসাগর–গভীর, গম্ভীর, ভয়ঙ্কর, কখনও বা প্রমত্ত। মুহূর্তে মুহূর্তে এর রূপ বদলায়, মেজাজ বদলায়। এর হঠকারিতার অন্ত নেই, এর খামখেয়ালকে বিশ্বাস নেই। কখন যে কালা পানি মেতে উঠবে, ঝড় তুলবে, কখন যে ফুলে ফুলে জল আকাশ-সমান উঁচু হবে, আর কখন যে একান্ত অবলীলায় মহাকায় জাহাজ ডুবিয়ে অথৈ অতলে টেনে নেবে, আগে থেকে হদিস মেলে না।
.
বিরাট একটা জলচর মাছের মতো ঢেউ কেটে এগিয়ে চলেছে এস. এস. এলফিনস্টোন। জাহাজ এখন দক্ষিণগামী।
অনেক আগেই সকাল হয়েছে।
অগাধ সমুদ্র থেকে একটি সোনালি গোলক একটু একটু করে আকাশের গা বেয়ে জাহাজের মাথায় এসে উঠেছে। দরিয়ার সূর্য, তার তেজ ভয়ানক।
নীল আকাশটা ঝকঝক করে। টুকরো টুকরো হালকা মেঘ উত্তর থেকে দক্ষিণে, আড়াআড়ি পাড়ি জমায়। নিচে নোনা জলের দরিয়া ফুঁসতে থাকে। সমস্ত সমুদ্র জুড়ে যতদূর দৃষ্টি চলে, শুধু কোটি কোটি ঢেউয়ের মাথা ঝকমক করে।
চার নম্বর হ্যাচে তিন কয়েদি ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে ছিল। মাঝখানের কয়েদিটির মাথা দু’হাঁটুর মধ্যে গোঁজা। কোমর থেকে শরীরের ওপরের অংশটা নগ্ন। পরনে লম্বা লম্বা কালো দাগকাটা ইজের। গায়ের রং পোড়া তামার মতো। চওড়া কাঁধ, মজবুত গর্দান। বিরাট দেহে থরে থরে কঠিন পেশি। মাথার চুল নিরপেক্ষ ভাবে ছোট এবং সমান করে ছাঁটা। দু’পায়ে লোহার বেড়ি। নাম লখাই।
ডান পাশ থেকে একটা গলা শোনা গেল, লখাই ভাই—
লখাই মাথা তুলল। ঘোর ঘোর রক্তাভ চোখ, মণি দু’টি লাল। উদ্ধত চোয়াল, চোখের নিচে হনু দু’টি অতি প্রকট। রোমশ বুক, চ্যাপ্টা নাক, মাংসল কাঁধ। সমস্ত শরীরে মোটা
মোটা শক্ত হাড়।
ডাইনে তাকাল লখাই। দেখল, তোরাব আলি সমুদ্রের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে।
সারা মুখে হিংস্র ভঙ্গি ফুটল লখাইর। ভাঙা, কর্কশ গলায় সে বলল, আঁই হারামী, কী কইচিস?
কালা পানি রে লখাই ভাই! ফিসফিস স্বরে তোরাব আলি বলল। তার গলায় কাঁপুনি ধরেছে।
হুঁ। সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে আবার হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজল লখাই।
আকারে প্রকারে তোরাব আলি লখাইর মতো মারাত্মক নয়। বেঁটেখাটো দোহারা চেহারা। কিন্তু ছোট ছোট গোলাকার চোখ দুটো অতি ধূর্ত, অতি কুটিল। ঠোঁটের পাশ থেকে কান পর্যন্ত ডান গালে পুরু কাটা দাগ। এই দাগটা এবং কুটিল একজোড়া চোখ তার মুখটাকে ভয়ঙ্কর করে তুলেছে।
তোরাব আলি ফের ডাকল, লখাই ভাই—
লখাই জবাব দিল না।
আপন মনেই এবার তোরাব বলতে লাগল, সমুন্দরের পার কূল নাই। দরিয়া দেখে বুকের লৌ যে পানি হয়ে যায়। হা আল্লা, কোথায় জন্ম দিলে আর কোথায় মারতে নিয়ে চলেছ। তোমার মর্জি বুঝি না।
অনেকটা সময় কাটে।
লখাই কথা বলে না। এই বিপুল সমুদ্রের মতোই আল্লার মর্জির পারকুল না পেয়ে চুপচাপ বসে থাকে তোরাব।
জাহাজটা মুহূর্তের জন্য থামে না। ধক ধক অদ্ভুত শব্দ করে অবিরাম ছুটতে থাকে। চাকার ঘা লেগে লবণসমুদ্র গেঁজে ওঠে। কালো দরিয়ায় পুঞ্জ পুঞ্জ তুষারের মতো সাদা
ফেনা ফোটে।
চারদিকে শুধু জল, কালো কুটিল জল। নিঃসীম, অফুরন্ত বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগর তো কোনোদিন শুকোয় না, কোনোকালে ফুরোয় না। এর জলতলের মাটি কেউ কখনও দেখে নি, চিরকাল গোপন হয়েই আছে।
তোরাব হঠাৎ বলে, জবর ডর লাগে লখাই ভাই–
ডর লাগে! দু’হাঁটুর ফাঁক থেকে মুখ তুলে তাকায় লখাই। বলে, কেন?
দরিয়া দেখে, কালা পানি দেখে।
লখাই খেপে ওঠে। রক্তাভ চোখজোড়া জ্বলতে থাকে। সে বলে, মানুষের খুন দেখে ডর লাগে না, পানি দেখে লাগে! চুপ মার কুত্তা, এটুন ঘুমুতে দে।
জাহাজের দোলানিতে কাল সারারাত এক দণ্ড ঘুমাতে পারে নি লখাই। কপালের দু’পাশে সরু সরু রগগুলো যন্ত্রণায় ফুলে উঠেছে, দাপাদাপি করছে। মোটা মোটা আঙুলে টিপেও তাদের বাগ মানানো যাচ্ছে না।
বিরক্ত চোখে ভোরাবের দিকে একবার তাকিয়ে আবার হাঁটুর ফাঁকে মাথা নামায় লখাই।
আর সঙ্গে সঙ্গে বাঁ পাশ থেকে আর্তনাদ ওঠে।
চমকে তাকায় লখাই। লোকটা দুহাতে মুখ ঢেকে শব্দ করে কাঁদছে। আউটরাম ঘাটেই প্রথম দেখেছে, লোকটা বর্মা মুলুকের। নামটাও জেনে নিয়েছে লখাই। মঙ চো।
ধারাল কনুইটা দিয়ে মঙ চোর পাঁজরে সজোরে খোঁচা দিল লখাই। তারপর খেঁকিয়ে উঠল, কি রে শালা, চিল্লাচ্ছিস কেন?
মুখ থেকে হাত নামায় মঙ চো। কুতকুতে চাপা চোখ দুটো কান্নায় বুজে গিয়েছে। মুখটা বিকৃত দেখাচ্ছে। ভাঙা ভাঙা গলায় দুর্বোধ্য ভাষায় হাউ হাউ করে কী যে সে বলে, কিছুই বোঝা যায় না। হাত বাড়িয়ে বার বার সে সামনের সমুদ্র দেখায়।
লখাই চেঁচায়, হারামীটা কী বলে রে, এট্টুও বুঝি না।
তোরাব বলে, দরিয়া দেখে বুঝি ডর লেগেছে বর্মীটার।