ব্লেয়ার এবং কোলব্রুক সার্ভে রিপোর্ট পেশ করলেন। পরের বছরই সেটেলমেন্টের কাজ আরম্ভ হল। কতকালের দুর্ভেগ্য অরণ্য সংহার করে চ্যাথামে এবং বর্তমান পোর্ট ব্লেয়ারে কলোনি তৈরি হল। কিন্তু তিন বছরের মধ্যেই সেটেলমেন্টের কাজ উত্তর-পূর্ব দিকের পোর্ট কর্নওয়ালিসে তুলে আনা হয়। বন্দর এবং সুরক্ষিত পোতাশ্রয়ের পক্ষে পোর্ট কর্নওয়ালিস নিরাপদ। কিন্তু এই দ্বীপটি অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর এবং মৃত্যুর হার অস্বাভাবিক হওয়ায় চার বছরের মধ্যেই সেখানকার কলোনি উঠে যায়।
পুরাতন নথিপত্রে পরবর্তী ষাট বছরের বিশেষ উল্লেখ নেই।
লা ডিন বলেছিলেন, বাবুজি, দুনিয়ার হরেক কিসিমের পাপীতাপীর আস্তানা এই আন্দামান। এখানে দেখবেন মদের নেশায় চুর হয়ে কয়েদি নিজের আওরতকে অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছে। এক রতি আফিমের জন্যে মানুষ এখানে চাকু চালায়। এখানে কথায় কথায় কোতল, কথায় কথায় ছোরাছুরি। তবু এই দ্বীপের একটা আত্মা আছে, বড় সন্দুর আত্মা। সেই আত্মাকে খুঁজবেন। তার খোঁজ না পেলে আপনার আন্দামানে আসা বৃথা হবে।
অবাক হয়ে লা ডিনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এই মানুষটিকে যত দেখছি ততই বিস্মিত হচ্ছি।
চোখ বুজে লা ডিন আবার শুরু করেছিলেন। তার কথাগুলি সাজিয়ে নিলে এমন দাঁড়ায়। সমুদ্রের অতল থেকে এই দ্বীপমালা কবে উঠেছিল, কবে যে নিবিড় অরণ্যের ঘাগরায় নিজেকে সাজিয়েছিল, কে বলবে। সুদূর অতীত, গহীন অরণ্য, চারপাশের গর্জমান সমুদ্র, পাপ-তাপ, আকাশ বাতাস-অন্তরীক্ষ এবং আলো-অন্ধকারের মধ্যে এইদ্বীপের সুন্দর আত্মাটি সঙ্গোপন হয়ে আছে। অতি সন্তর্পণে তাকে খুঁজে নিতে হবে। বার বার হয়তো ব্যর্থ হতে হবে। সে-আত্মা ধরা দিয়েও দেবে না। তবু অসহিষ্ণু হলে চলবে না।
লা ডিন বলেছিলেন, বাবুজি, নিরাকাঙক্ষ না হলে আত্মাকে ধরা যায় না। যোগী-সন্ত ভিক্ষু বাসনা–মুক্ত হয়েই আত্মার মহিমা বুঝতে পারে। আপনি লেখক, মনে মনে আপনিও
তো সাধক—
হঠাৎ থেমে গিয়েছিলেন লা ডিন।
.
পোর্ট কর্নওয়ালিসের কলোনি উঠে যাওয়ার পর একটি একটি করে ছোট-বড়-মাঝারি, অনেকগুলি কারণ জমা হচ্ছিল। মালয়ী জলদস্যুদের উপদ্রব, জাহাজডুবি, নাবিকদের ওপর দ্বীপবাসী আদিম মানুষগুলির আক্রমণ, এমনি অসংখ্য। সর্বপ্রধান এবং সর্ববৃহৎ কারণটি পাওয়া গেল আঠার শ’ সাতান্নতে। এই বছরটা সিপাহি বিদ্রোহের বছর। ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিদ্রোহীদের বহুদূরে নির্বাসন দেওয়ার একান্ত প্রয়োজন দেখা দিল।
আঠার শ’ আটান্ন সালের চৌঠা মার্চ আন্দামানের ইতিহাস অবিস্মরণীয় তারিখ। এই তারিখেই ডক্টর জে. পি. ওয়াকার দু শ’ জন বন্দি, একজন নেটিভ ওভারসিয়ার, দুজন ডাক্তার এবং ওল্ড ন্যাভাল ব্রিগেডের পঞ্চাশটি রক্ষী নিয়ে সেমিরামিস জাহাজে আন্দামান যাত্রা করলেন।
বঙ্গোপসাগরের বিচ্ছিন্ন দ্বীপমালায় স্থায়ী উপনিবেশ পত্তন সম্ভব হল। জীবনের সীমানা দীর্ঘ হল।
লা ডিন বলেছিলেন, ওই যে বললাম বাবুজি, নিরাকাঙ্খ না হলে আত্মাকে ধরা যায় না। কথাটা মনে রাখবেন।
বুদ্ধমূর্তির সামনে বসে ছিলাম। সেদিকে তাকিয়ে ভাবলাম, নিরাসক্ত এবং নির্লিপ্ত হয়ে আন্দামানের আত্মাকে খুঁজব। এ এক দুরূহ ভাবনা, বড় কঠিন পরীক্ষা। জানি না বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপমালার ঘুরে ঘুরে পাহাড় বনস্পতি-সমুদ্র, মানুষ এবং নিসর্গের মধ্যে তার গহন গোপন আত্মাকে খুঁজে পেয়েছি কিনা।
সে-দিন ফুঙ্গি চাউঙ থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম।
মেজো ফুঙ্গি লা ডিন তন্ময় হয়ে তখন বুদ্ধপদ আবৃত্তি করছিলেন। তার কণ্ঠের ঝঙ্কার অনেকক্ষণ ধরে আমার কানে বাজছিল।
ন নগ্গচরিয়া, না জটা, ন পঙ্কা।
অনাসকা থণ্ডিলা সায়িকা বা।
রজোব জল্লং উকুটি কপ্পধানং,
সোধন্তি মচ্চুং অবিতিন্ন কঙ্ক্ষং।
.
আখ্যান
উনিশ শ’ এগার সালের এক দিন।
আউটরাম ঘাট থেকে আড়াই শ’ কয়েদি নিয়ে একটি জাহাজ আন্দামানে পাড়ি দিল। জাহাজটির নাম এস. এস. এলফিনস্টোন।
কাল সমস্ত দিন হুগলি নদীর গৈরিক জল দেখা গিয়েছে। অস্পষ্ট হলেও দু’পারে তীর দেখা যাচ্ছিল। এক ঝক সাগরপাখি মাস্তুলের ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে আসছিল। দুই তীরের বাঁধনে আকাশটা ছোট হয়ে গিয়েছিল। তাকে মাপা না গেলেও তার সম্বন্ধে ধারণা বিরাট ছিল না।
আকাশে শীতের রোদ ছিল, রোদে মাধুর আমেজ ছিল, দিগন্তে ঘন কুয়াশার স্তর ছিল। নদীর ঢেউ কুঁড়ে কুঁড়ে বাতাস উঠছিল, বাতাসে হিম মিশে ছিল। ঠাণ্ডায় মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে তীব্র কনকনানি ছুটে যাচ্ছিল যেন।
কিন্তু শীতের এই রোদ, আকাশ, নদীতীর, কুয়াশা–সবই বড় চেনা। এই কনকনানির অনুভূতি বড় পরিচিত।
তারপর একটি রাতের কারসাজিতে এমন বিস্ময় ঘটে গেল। এক ফুঙ্কারে পরিচিত পৃথিবীটা কোথায় অদৃশ্য হল। কোথায় পড়ে রইল রূপনারায়ণের মোহানা আর কোথায় রয়ে গেল সাগদ্বীপ!
ডায়মণ্ড হারবার পেরিয়ে গেরুয়া জল যখন সবুজ হল, তখনও শীতের বেলাশেষ নিভু নিভু আলো দিচ্ছিল। একটু পরেই ছায়া ছায়া অন্ধকার নেমেছিল। তারপর স্যান্ড হেডের মুখে এসে বৃত্তাকারে বাঁক নিয়ে নদী কখন সঙ্গমে মিশল, কখন সবুজ জল নীল হল, নীল কখন কালাপানি হয়ে নিঃসীম সমুদ্র হয়ে গেল–সে কথা আড়াই শ’ কয়েদি একবারও ভাবে নি। এমন বিপুল বিস্ময় তারিফ করার মতো মনই নয় তাদের।