অনুমানের ওপর নির্ভর করলে দেখা যায়, খ্রিস্টজন্মের হাজার খানেক বছর আগে চিনা এবং জাপানিরা আন্দামানের কথা জানত। চৈনিক উচ্চারণে আন্দামান ইয়েঙ-ততা-মাঙ হয়েছিল। জাপানিরা বলত আন্দাবান।
বঙ্গোপসাগরের নাবিকরা হাজার হাজার বছর ধরে যে রূপকথা বানিয়েছে তাতে আছে, এক ঝক সাগর-পাখি দিক ভুল করিয়ে দুজন আরব নাবিককে আন্দামানে নিয়ে এসেছিল। আন্দামানের মাটিতে বিদেশি মানুষের সেই বোধ হয় প্রথম পদক্ষেপ। তারপর কত মানুষই না এল, কত দেশের কত জাহাজই না ভিড়ল!
পূর্বদেশীয় উপকথার সওদাগরই শুধু নন, সুপ্রাচীন কাল থেকে ভারতীয় এবং আরব বণিকেরা, বৌদ্ধ ভিক্ষুণী ও শ্রমণেরা বার বার পূর্ব সমুদ্রে পালের জাহাজ ভাসিয়েছেন। সমাপ্তিহীন বঙ্গোপসাগরের মধ্যপথে আরাম-বিশ্রাম-খাদ্য আর স্বাদু জলের সন্ধানে আন্দামান দ্বীপমালায় তাদের বহর থেমেছে।
সে-সব দিনে মালয়ী ও চিনা জলদস্যুরা আন্দামানের উপকূলে হন্যে হয়ে ঘুরত। সুযোগ পেলেই এখানকার আদিম অধিবাসীদের ধরে নিয়ে শ্যাম, কম্বোডিয়া এবং ইন্দোচিনের রাজদরবারে বিক্রি করে দিত।
আন্দামানের উপকূলে কত জাহাজডুবি হয়েছে, এই সব দ্বীপের আদিম বাসিন্দাদের তীরে কত নাবিক প্রাণ হারিয়েছে, তার হিসাব কে রাখে। তবু নানা দেশ থেকে এখানে জাহাজ আসার বিরাম ঘটে নি। বিদেশিরা এসে একদিন এই দ্বীপপুঞ্জ দখল করে বসেছিল।
লা ডিন বলেছিলেন, বাবুজি, আন্দামানের মিট্টিতে পঞ্চাশটা বছর কেটে গেল। এই দ্বীপের হরেক চীজ দেখলাম। জঙ্গল সাফ হয়ে শহর হল। সেলুলার জেল তৈরি হল। রস্ দ্বীপে রোশনি ফুটে উঠল, আবার নিভেও গেল। কত জাতের কত ধাতের মানুষই দেখলাম! মোপলা দেখলাম, পাঠান-পাঞ্জাবি-কারেন দেখলাম, বর্মী বাঙালি-চিনা দেখলাম।
হ্যাঁ, অনেক দেখেছেন লা ডিন। প্রিয়জন-পরিজনহীন এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে দিনের পর দিন কাটিয়ে কত কয়েদি বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। অতিষ্ঠ হয়ে কেউ সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে হাঙরের দাঁতে ছিন্নভিন্ন হয়েছে। ভাগোয়া কয়েদি গভীর অরণ্যে পালিয়ে জারোয়াদের তীরে প্রাণ দিয়েছে। অত্যাচার আর পীড়ন সইতে না পেরে কেউ কেউ ছোট ডিঙিতে বিপুল সমুদ্র পাড়ি দিতে চেয়েছে। তারপর পাহাড়-প্রমাণ ঢেউয়ের মর্জিতে কোথায় ভেসে গিয়েছে, পৃথিবীর কেউ খোঁজ রাখে নি।
অনেক, অনেক দেখেছেন লা ডিন। কয়েদির রক্তে, ঘামে এখানে সড়ক তৈরি হয়েছে। কয়েদির হাড় সাজিয়ে সমুদ্রের দেওয়াল বাঁধা হয়েছে। আন্দামানের মূক মাটিতে অনেক দীর্ঘশ্বাস, অনেক লোহু, অনেক স্বেদ এবং অভিশাপ গোপন হয়ে আছে।
সবই জানেন লা ডিন।
লা ডিন বলেছিলেন, বাবুজি, দেখলাম তো বহুত, পেলাম কী? পেয়েছি বাবুজি, বহুত পেয়েছি, একদিন আপনাকে বলব।
কিন্তু পরের কথা অনেক আগে এসে গেল। এখন উজান ঠেলে না পিছিয়ে উপায় নেই।
.
বঙ্গোপসাগরের দু শ’ চারটি দ্বীপের স্থানমাহাত্ম্য যত, নামমাহাত্ম্য তার চেয়ে তিল পরিমাণ কম নয়। কোত্থেকে কিভাবে আন্দামান নামের উদ্ভব, তার হদিস পাওয়া দায়। চিনাদের ইয়েঙ-তো-মাঙ, জাপানিদের আন্দাবান না হয় বাদই দেওয়া গেল।
মার্কো পোলো বঙ্গোপসাগরে ‘আঙ্গামানিয়ান’ নামে দ্বীপমালা দেখেছিলেন। সপ্তম শতকে চৈনিক ভিক্ষু তি সিঙ এই দ্বীপে এসেছিলেন। সে-সময় এর নাম ছিল ‘আগদামান’। ক্লডিয়াস টলেমি এই দ্বীপকে ‘আগমাটে’ নামেও জানতেন। চোদ্দ শ’ চল্লিশে পরিব্রাজক নিকলো কন্টি আন্দামানকে স্বন্দ্বীপ আখ্যা দিয়েছিলেন। যোড়শ শতকে মাস্টার ফ্রেডরিক নিকোবর থেকে পেগু পর্যন্ত এক সারি দ্বীপ দেখেছিলেন। এখানকার বন্য অধিবাসীরা তাদের এই দ্বীপপুঞ্জকে নাকি ‘আণ্ডেমেওন’ বলত। মালয়ীরা আন্দামানের আদিম বাসিন্দাদের বলত ‘হণ্ডুমানী’।
এই নামাবলির কোনটি থেকে ‘আন্দামান’-এর উৎপত্তি, কে বলবে।
লা ডিন বলেছিলেন, বাবুজি, এই আন্দামান সহজ জায়গা নয়। কোতল-রাহাজানি ডাকাতি না করলে এখানে আসা যায় না। যেদিকে তাকাবেন, যে মুখটি দেখবেন, হয় সে হত্যারা, নয় ডাকু। সে জন্যে মনে ঘৃণা রাখবেন না। একটু দরদি হবেন। সকলের বুকে কান রেখে দিলের কথা শুনবেন, তারপর তাদের মুখের দিকে তাকাবেন। দেখবেন, তারা খুব খারাপ নয়। কয়েদিরাও মানুষ।
মুগ্ধ হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
লা ডিন আবার শুরু করেছিলেন, বাবুজি, খুনি আর ডাকু ছাড়া অন্য মানুষও আছে। ইণ্ডিয়ার আজাদের জন্য যে-সিপাহিরা.প্রথম লড়াই করেছিল, তাদের নিয়েই আন্দামানের বন্দি কলোনির পত্তন। বর্মাকে আজাদ রাখার জন্যে রাজা থিবোর হয়ে যারা লড়েছিল, তাদেরও এখানে পাবেন। ইণ্ডিয়ার স্বদেশি বাবুদেরও খোঁজ নেবেন। সবারই সাধ ছিল, নিজের নিজের দেশকে আজাদ করবে। কিন্তু–
হঠাৎ থেমে গিয়েছিলেন লা ডিন। সামনেই বিরাট বুদ্ধমূর্তি। প্রসন্ন, ক্ষমাসুন্দর, ভগবান তথাগত। তন্ময় দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন লা ডিন। বিড়বিড় করে কী যেন বলতে লাগলেন। শুনতে পেলাম না।
.
আন্দামানের হাল আমল শুরু হল সতর শ’ আটাশি সালের সেপ্টেম্বর মাসে। লর্ড কর্নওয়ালিস লেফটেনান্ট কোলব্রুক এবং লেফটেনান্ট ব্লেয়ারকে আন্দামান দ্বীপমালায় সার্ভের জন্য পাঠান। তার উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে এই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে একটি উপনিবেশ পত্তন করা।