- বইয়ের নামঃ সিন্ধুপারের পাখি
- লেখকের নামঃ প্রফুল্ল রায়
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. ১৯১১ সালের এক দিন
সিন্ধুপারের পাখি – প্রফুল্ল রায়
দেজ পাবলিশিং, কলকাতা
SINDHUPARER PAKHI – A Bengali Novel by PRAFULLA Roy Published by Sudhangshu Sekhar Dey, Deys Publishing
প্রথম দেজ সংস্করণ : এপ্রিল ১৯৮১, বৈশাখ ১৩৮৮
চতুর্থ রাজ সংস্করণ : জানুয়ারি ২০১৩, মাঘ ১৪১৯
পঞ্চম সংস্করণ : জানুয়ারি ২০১৭, মাঘ ১৪২৩
অগ্রজপ্রতিম
শ্রীকানাইলাল সরকার
পরম শ্রদ্ধাস্পদেষু
.
এই উপন্যাসে কোন জাতি, ধর্ম বা ব্যক্তির উপর কটাক্ষ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। আমার দৃষ্টিতে জাতি, ধর্ম বা বর্ণের চেয়ে মানুষ অনেক বড়, অনেক মহান। মানুষের মৌল গুণগুলির উপর অটুট বিশ্বাস, শ্রদ্ধা এবং আস্থা রেখে এ গ্রন্থ লিখতে চেষ্টা করেছি।
ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক পটভূমি এবং আনুষঙ্গিক কিছু কিছু বিষয় ছাড়া এই উপন্যাসের সমস্ত চরিত্র ও ঘটনা কাল্পনিক। কোন চরিত্র ও ঘটনার সঙ্গে বাস্তব ক্ষেত্রে সামান্য মিলও যদি থেকে থাকে তা নিতান্তই যোগাযোগ। এ সম্বন্ধে আমার কোন দায়িত্ব নেই।
যাঁদের অকুণ্ঠ সহায়তা ছাড়া এই উপন্যাস কোনদিনই লেখা সম্ভব হত না, তারা হলেন অগ্রজপ্রতিম শ্রীকানাইলাল সরকার, পোর্টব্লেয়ারের ম্যাজিস্ট্রেট বন্ধু শ্রীসাধন রাহা, আন্দামান-নিকোবরের এঞ্জিনীয়ার ও হারবার মাস্টার মিঃ স্যাণ্ডেল, শ্রীধীরেন্দ্রনাথ পাল, উত্তর আন্দামানের শ্রীবিকাশ চক্রবর্তী এবং ডাণ্ডাস পয়েন্টের থানাদার শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁদের কাছে আমার ঋণ অফুরন্ত।
এই উপন্যাসের নামকরণ করে দিয়েছেন অগ্রজপ্রতিম শ্ৰীসাগরময় ঘোষ। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা মনে রেখে নিছক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বাহুল্য মনে করি।
লেখক
কলকাতা
২০শে ফাল্গুন, ১৩৬৫
.
কথামুখ
‘Life is not a series of gig-lamps symmetrically arranged.’
পূর্বদেশীয় উপকথার উল্লেখ আছে, এক অজ্ঞাতনামা সওদাগর দুস্তর সমুদ্রে সপ্তডিঙা মধুকর ভাসিয়ে ‘আন্ধারমাণিক্যে’ পৌঁছেছিলেন। সম্ভবত এই ‘আন্ধারমাণিক্য’ই আন্দামান।
অতীত-কথা মাত্রেই অমৃতসমান। কিছু মোহ, কিছু আবেশ এবং কল্পনার কিছু বিলাস মিশিয়ে চোখ বুজে যে অস্পষ্ট, ধূসর অতীতের ধ্যান করি, তা অতি রমণীয়। তার স্বাদ মধুর।
বঙ্গোপসাগরের দু শ’ চারটি দ্বীপের সমষ্টি আন্দামান। তার অতীত কুহেলিবিলীন। ইতিহাসের ফাঁকগুলি কল্পনা আর অনুমান দিয়ে রিফু করে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
কয়েক বছর আগেও আন্দামানের সঙ্গে কালা পানি নামে একটা ভয়ানক শব্দ মিশে ছিল। আর এই কালা পানির সঙ্গে মিশে ছিল বিভীষিকা, নিগ্রহ, দ্বীপান্তর এবং কুখ্যাত সেলুলার জেল। কিন্তু এ তো মাত্র বিগত কয়েক দশকের ইতিহাস, আমাদের সকলেরই জানা। সবার জানাশোনার পেছনেও আন্দামানের একটা বিপুল অতীত আছে। এখানে এসেছে বহু দেশ, বহু জাতির মানুষ। নাবিক-বণিক-পরিব্রাজকের মুখে মুখে প্রচলিত হাজার রূপকথায়, কিংবদন্তিতে এবং উচ্চারণভঙ্গিতে বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপমালার নাম ছড়িয়ে রয়েছে।
পোর্ট ব্লেয়ারের ফুঙ্গি চাউঙে বসে অনেক কথাই শুনেছিলাম।
মেজো ফুঙ্গি লা ডিন ত্রিকালদর্শী পুরুষ। সে কাল দেখেছেন, এ-কাল দেখছেন এবং যে বোধি থাকলে আগামী কালকে দেখা যায়, তা তার আছে।
বিচিত্র মানুষ লা ডিন। প্রথম জীবনে সুমাত্রা-জাভা-বলিদ্বীপে, শ্যাম-কাম্বোডিয়া মালয়ে-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বন্দরে বন্দরে নিরুদ্দেশ হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আঠার-শ চুরাশি পঁচাশিতে তৃতীয় বার ইংরেজদের সঙ্গে ব্রহ্মদেশের যুদ্ধ বাধে। হঠাৎ ব্রহ্মরাজ থিবোর পক্ষে লড়াই করে বন্দি হয়ে তিনি আন্দামান এসেছিলেন।
প্রথম জীবনের দুঃসাহসী পরিব্রাজক, মধ্য জীবনের সৈনিক, শেষ জীবনে কেমন করে ফুঙ্গি হলেন, সে কাহিনী অন্য। সে-কথা অনেক পরের। তবে সত্তর বছরের জীবনে অনেক দেখেছেন, অনেক শুনেছেন লা ডিন। দেখা এবং শোনার চেয়ে অনেক বেশি বুঝেছেন। বিশাল অভিজ্ঞতা আর বিরাট উপলব্ধির কথা সহৃদয় সমঝদার পেলে তিনি অনর্গল শোনান।
তাঁর কাছেই আন্দামানের অতীত-কথা শুনেছিলাম।
প্রথমেই লা ডিন বলেছিলেন, বাবুজি, ঐতিহাসিক টলেমি আন্দামানকে আগাথু ডাইমনস নেসস (উত্তর আত্মার দ্বীপ) বলেছিলেন। আমার মনে হয়, ভুল তিনি করেন নি। খুব খাঁটি কথাই বলেছিলেন। এই দ্বীপে ইনসানিয়াতের বিচার চলছে। হাঁ বাবুজি, নয়া ইনসাফ। এই দ্বীপে একদিন মহান আত্মা জন্ম নেবে।
বর্মী লা ডিনের মুখে হিন্দি এবং উর্দু একাকার হয়ে অদ্ভুত শোনায়। এই বিচিত্র ভাষার মহিমা অনেক পরে বুঝেছিলাম।
.
এবার আন্দামানের ইতিহাস দেখা যাক। কোথায় যেন শুনেছিলাম, পুরাতত্ত্বের তুল্য সরস আখ্যান আর নেই। সময়ের মতো কাহিনীকার মেলা দুষ্কর। গাল্পিক ঘটনা বুনে বুনে গল্প বানান। কিন্তু ইতিহাস হল জাত গল্প। প্রয়োজনের খাতিরে সেখানে ঘটনা ঘটে, চরিত্র সৃষ্টি হয়। সেখানে তাল-মান-মাত্রা বজায় রেখে কল্পনার মিশেল দিয়ে নিটোল কাহিনি ফাঁদবার হাঙ্গামা নেই।
আন্দামানের ঐতিহাসিক কাহিনি অপূর্ব।