পরীক্ষিতের পুত্র জনমেজয় ভাইদের সঙ্গে মিলে এক যজ্ঞ আরম্ভ করেছিলেন। জনমেজয়ের ভাইরা হলেন- শ্রুতসেন, উগ্রসেন এবং ভীমসেন। তাদের যজ্ঞ চলার সময়। একটি কুকুর সেখানে উপস্থিত হল। জনমেজয়ের ভাইরা যজ্ঞস্থলে কুকুর দেখে সেটিকে যথেষ্ট মারধর করে তাড়িয়ে দিলেন। কুকুরটি কাঁদতে কাঁদতে কুকুর-মায়ের কাছে গিয়ে উপস্থিত হল। তার মা ছেলেকে চেটে আদর করে বলল, কাঁদছিস কেন? কে তোকে মেরেছে? সে বলল, রাজা জনমেজয়ের ভাইরা আমাকে খুব মেরেছে মা। মা-কুকুর বলল, তুই নিশ্চয়ই কোনও অন্যায় করেছিস, নইলে শুধু শুধু তারা তোকে মারবে কেন? ছেলে কুকুর বলল, না গো মা। আমি কিচ্ছুটি করিনি। আমি যজ্ঞের ঘিয়ের দিকে ফিরেও তাকাইনি, চাটিওনি সেই ঘিনাপরাধ্যামি কিঞ্চিৎ, নাবেক্ষে হবীংষি নাবলিহে ইতি। বস্তুত এই বাচ্চা কুকুরটিও জানে অথবা কুকুর-মায়ের কাছে সে প্রশিক্ষণ পেয়েছে যে, যজ্ঞের ঘি চাটতে নেই, দেবতার অগ্রভাগ লোভের দৃষ্টিতে দেখতে নেই।
কুকুর-মা ছেলের অভিযোগ শুনে রাজা জনমেজয়ের কাছে যজ্ঞস্থলেই উপস্থিত হল। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে সে রাজাকে বলল, এই আমার ছেলে। একটা কোনও অপরাধ করেনি সে, না চেটেছে ঘি, না ফিরেও সেদিকে চেয়ে দেখেছে; ততো কেন তাকে মারা হল? জনমেজয় সামান্যা কুকুরীর কথার জবাব দিতে পারলেন না। লজ্জায় তার ভায়েরা মাথা নিচু করলেন। কুকুর-মা বলল, যেহেতু কোনও অন্যায় না করেও আমার ছেলে শুধু শুধু মার খেল, তার ফল ভুগতে হবে এই রাজাকে। দেখবে, এমন কোনও ভয় তোমাদের সামনে এসে উপস্থিত হবে, যা তোমরা ভাবতেও পারছ না–যৗঁদভিহতোনপকারী তস্মাদদৃষ্টং ত্বাং ভয়মাগমিষ্যতি।
এখানে দুটি-তিনটি জিনিস ভাবার আছে। এখনকার দিনে–অন্যায় না করে যদি মার খেতেন, তাহলে সেটাই হত স্বাভাবিকতা। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক হয়ে উঠবে তখনই, যদি নিরপরাধে মার খাওয়ার পরেও আপনি যদি ন্যায়বিচার চাইতে যান। উকিলে ছুঁলে তো ছত্রিশ ঘা, আর যদি সোজাসুজি পুলিশের কাছে যান, তবে আরও মার খাওয়ার ভয়, আর যদি গণতন্ত্রের রাজদ্বারে যান, তবে শুনবেন, এমন তো হয়েই থাকে, কী আর করা যাবে। কিন্তু সে যুগে একটি সামান্য কুকুরও কিন্তু স্বয়ং যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হয়ে খোদ রাজার বিরুদ্ধেই অভিযোগ জানিয়েছে। বলতেই পারেন- কুকুরের কথাটা রূপকমাত্র, কুকুর কী আর কথা বলে? অভিযোগ জানায়? আমাদের বক্তব্য, রূপক বলেই এই ঘটনার সামাজিক মূল্য আরও বেশি। অর্থাৎ একজন সামান্য প্রাণী-মাত্রেরও রাজার দরবারে যাওয়া এবং স্বয়ং তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনার ক্ষমতা ছিল, আজকের এই সোনার গণতন্ত্রে যা অসম্ভব।
দ্বিতীয়ত, যে সমাজের স্বার্থান্বেষীরা বিধান দিয়েছিলেন-শকুনের অভিশাপে গরু মরে না– এ সমাজ তার থেকে প্রগতিশীল। পরবর্তীকালে যে সময়ে উচ্চবর্ণের ব্যক্তিরা নিজেরা সৎ আচরণ না করে অন্যকে অভিশাপের ভয় দেখাতেন, সেই সমাজে নিম্নবর্ণের ব্যক্তিরা যদি অতিষ্ঠ হয়ে উচ্চতরের প্রতি অপশব্দ উচ্চারণ করতেন, তবে শুনতে হত- শকুনের অভিশাপে গরু মরে না। কিন্তু এখানে দেখছি-শকুন না হোক, কুকুরের অভিশাপে রাজা। লজ্জিত, চিন্তিত, ব্যতিব্যস্ত-ভূশং সম্রান্তো বিষণ্ণশ্চাসীং। যজ্ঞ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজা হস্তিনানগরীতে ফিরে এসেছেন এবং ভীষণভাবে চিন্তা করতে আরম্ভ করেছেন। তিনি একজন উপযুক্ত পুরোহিতের খোঁজে বেরিয়েছেন, যিনি কুকুরীর ওই অভিশাপ নিরস্ত করতে পারেন। এমনি খুঁজে পুরোহিত পাওয়া যায়নি। শেষে একদিন মৃগয়ায় বেরিয়ে একটি মুনির আশ্রম চোখে পড়ে রাজার। মুনির নাম শ্রুতবা। তার উপযুক্ত পুত্র সোমশ্ৰবাকে পৌরোহিত্যে বরণ করে নিয়ে আসেন জনমেজয়।
ঋষির পৌরোহিত্যে কুকুরীর শাপ কতটা কেটে গিয়েছিল মহাভারতের কবি তা বলেননি, কিন্তু একজন রাজা সামান্যা কুকুরীর অভিযোগ এবং আক্ষেপে কতটা উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন, সেটা এযুগেও ভাবার মতো। আমাদের কাছে এই কুকুরীর বিবরণ তৃতীয় এক কারণে মূল্যবান। মহাভারতের মধ্যে যারা ব্রাহ্মণ্য-সংযোজনের চিহ্নে আতঙ্কিত হন, তাদের কাছে আমার নিবেদন- মহাশয়! এই কুকুরীর মর্যাদা-রক্ষার জন্য ক্ষত্রিয় রাজার দুশ্চিন্তা এবং লজ্জাবোধও কিন্তু ব্রাহ্মণদেরই সংযোজন। আমি অবশ্য এটাকে সংযোজন মনে করি না। আমি এটাকে মহাভারতের উপক্রমণিকা মনে করি। অপিচ আমি এটাকে ব্রাহ্মণ্য সংযোজনও মনে করি না, আমি এটাকে কবিওয়ালার গৌরচন্দ্রিকা মনে করি। যদি তাই হয়, তবে এটি সৌতি উগ্রশ্রবার সংযোজন অর্থাৎ অব্রাহ্মণের সংযোজন।
কথাটা অবশ্য এখানেও নয়, কথাটা হল- যা পেয়েছি প্রথম দিনে তাই যেন পাই শেষে। মহাভারতের মহাপ্রস্থানিক কুকুরের কাহিনী দিয়ে তার ভারতবংশের ইতিহাস শেষ করেছেন, সৌতি উগ্রশ্রবাও তাই আরম্ভ করেছেন এক কুকুরের কাহিনী দিয়ে। সারা মহাভারত জুড়ে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের ওপরে যে আপাত পক্ষপাত নিয়ে নব্য গবেষকেরা আহত বোধ করেন, তারা যেন এই মহাকাব্যের আদি এবং অন্তে সামান্য কুকুরের চরিত্র দেখে খানিকটা আশ্বস্ত বোধ করেন। তথাকথিত অধম প্রাণীর প্রতি করুশার চিহ্নে যে মহাভারতের আদি এবং অন্ত চিহ্নিত, তার সমস্ত মধ্যভাগ জুড়ে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের প্রতি নিরঙ্কুশ পক্ষপাতই যে শুধু থাকবে না সে কথা আমি শুরুতেই জানিয়ে রাখলাম।