সংকর বলেই ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষের এমন বিচিত্র সংকর মহাভারতের ইতিহাস বলার ভার সূতেরই ওপর। সংকর বলেই কালে কালে ভিন্ন ভিন্ন কবির ভিন্ন ভিন্ন সংবোজন তার কাছে অচ্ছুৎ নয়, তারা সব মিলিয়ে দিতে পারেন। মহাভারতের প্রত্যেক ঘটনার ওপর, প্রত্যেক আগন্তুক তত্ত্ব এবং তথ্যের ওপর সূতের মায়া আছে। আর মায়া আছে তাদের ওপর–যারা পূর্বে তাদেরই মতো করে মহাভারতের কথা শুনিয়েছেন। সহমর্মিতা আছে তাদের ওপর যারা তার সম-সময়ে মহাভারতের আখ্যান বলে যাচ্ছেন। শুভেচ্ছা আছে তাদের জন্য যারা ভবিষ্যতে ভারত-কথার মর্যাদাতেই মহাভারত শোনাবেন- আখ্যাস্যন্তি তথৈবান্যে ইতিহাসমিমং ভুবি। আমার গর্ব আমি সেই সংকরজম্মা সূতের আশীর্বাদ-ভাগী –যে আজও মহাভারতের কাহিনী সূতের আশ্রয় নিয়ে বোঝাতে চায়। পাঠকেরা আমাকে কিছু কাল সহ্য করুন যাতে উগ্রশ্রবা সৌতির বিচিত্র কাহিনী আজকের দিনের মানসিকতায় আপনাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারি।
একটি কথা মহাভারতের কবির সমান হৃদয় নিয়ে বোঝা দরকার যে, মহাভারতের বিভিন্ন পর্বে ব্রাহ্মণের সংযোজন যাই থাকুক, কিন্তু সেই ব্রাহ্মণের স্পর্শদোষে মহাভারতের সার্বত্রিকতা নষ্ট হয়ে যায় না। সহানুভূতি নিয়ে স্মরণ করুন মহাপ্রস্থান পর্বের সেই আশ্রিত অস্পৃশ্য কুকুরের কাহিনী। মহারাজ যুধিষ্ঠির তাকে ধর্মরূপী বুঝে সঙ্গে নিয়ে যাননি, ঘৃণিত কুকুরত্বের মর্যাদা বা অমর্যাদাতেই যে যুধিষ্ঠিরের আশ্রয়-সরসতা ভোগ করেছিল। মহাভারতের শেষ, মহাপ্রস্থানের পথে একটি কুকুরেরও যে মর্যাদা বা সম্মান আছে, মহাভারতের আদিতেও তাই।
আমরা পণ্ডিত-অধ্যাপকদের কাছে শুনেছি যে, প্রাচীন কবি-নাট্যকারদের লেখার একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ছিল। তারা নাকি যে ঘটনা দিয়ে কাব্যারম্ভ করেন, কাব্য-বা নাটকের শেষেও নাকি সেই ঘটনা অথবা অনুরূপ ঘটনার সূচনা থাকে। অথবা কাব্য-নাটকের প্রথম ভাগটা যদি সমস্যা দিয়ে শুরু হয়, তবে শেষ হয় সমাধান দিয়ে। যেমন ধরুন কালিদাসের অভিজ্ঞান-শকুন্তল নাটকের প্রথম অঙ্কে কণ্বমুনির আশ্রমে আমরা প্রথম শকুন্তলা-দুষ্যন্তকে মিলিত হতে দেখেছি। তারপর অনেক বাধা, অনেক ঝড়-ঝঞ্জার পর নাটক-শেষের সপ্তম। অঙ্কে মঞ্চ স্থাপিত হয়েছে মহর্ষি মারীচের আশ্রমে। সেখানে আবার আমরা শকুন্তলা-দুষ্যন্তকে মিলিত হতে দেখছি। মহর্ষি কণ্বের আশ্রমে যে প্রণয়-কুসুম প্রস্ফুটিত হয়েছিল, মহর্ষি মারীচের আশ্রমে সেই প্রণয়-কুসুম ত্যাগের মাহাত্মে সুমধুর ফলে পরিণত হল। অন্য ক্ষেত্রে যদি ভগবদ্ গীতার মতো একটা দার্শনিক গ্রন্থের দৃষ্টান্ত গ্রহণ করি, তাহলে দেখবেন–গীতার আরম্ভ হচ্ছে অর্জুনের বিষাদ এবং মোহে। যুদ্ধক্ষেত্রে ভাই-বেরাদরকে দেখে অর্জুন একই সঙ্গে কৃপাবিষ্ট এবং মোহগ্রস্ত। তারপর অধ্যায়ের পর অধ্যায় জুড়ে দার্শনিক তত্ত্ব এবং তাত্ত্বিক বিবৃতি। অধ্যায়ের শেষে দেখা যাচ্ছে আবার সেই মোহের কথা ফিরে এসেছে। কৃষ্ণের উপদেশে। অর্জুন এখন সম্পূর্ণ মোহমুক্ত। সমস্যা যা ছিল তার সমাধান হয়ে গেছে। উপদেশদীপ্ত অর্জুনের মুখে তখন সদর্প ঘোষণা শোনা যাচ্ছে আর আমার কোনও মোহ নেই, কৃষ্ণ! আমি আবার। স্ব-রূপে প্রতিষ্ঠিত–নষ্টো মোহঃ স্মৃতি লা ত্বৎপ্রসাদাৎ ময়াচ্যুত। স্থিতোস্মি গতসন্দেহঃ করিষ্যে বচনং তব।
মহাভারত মহাকাব্যখানিকেও এই নিরিখে দেখা যায়। এখানেও মহাকাব্যের শেষে আমরা যেমন এক অধম কুকুরের কাহিনী দিয়ে মহাপ্রস্থানের শেষ সূচনা দেখতে পাচ্ছি, তেমনই ভারতকথার আরম্ভেও উগ্রশ্রবা সৌতি এক কুকুরের কাহিনী দিয়েই শুরু করেছেন। মহাভারতের মূল আরম্ভে অধ্যায়-সূত্র ছাড়াও আরও দু-চারখানা গল্প আছে বটে, তবে মহাভারতে যেহেতু কৌরব-পাণ্ডবের বংশ বিস্তার এবং তাদের যুদ্ধই প্রাধান্য পেয়েছে, তাই পাণ্ডবের শেষ বংশধর জনমেজয়ের কথা না বলে মহাভারতের কথায় প্রবেশই করা যায় না। জনমেজয়ই হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি তার সর্পযজ্ঞে ব্যাসদেবের কাছে মহাভারতের কথা শুনতে চান। অতএব মহাভারতের ঘটনা-সূচি বর্ণনা করেই সৌতি উগ্রশ্রবা জনমেজয়ের প্রসঙ্গে এসেছেন এবং জনমেজয়ের প্রসঙ্গ-মাত্রেই এসেছে একটি কুকুরের কাহিনী।
মনে রাখতে হবে একটি প্রাণী হিসেবে কুকুর যতই প্রভুভক্ত এবং মহনীয় হোক, কুকুর নিয়ে প্রাচীনদের কিছু শুচিবাইও ছিল। অবশ্য কুকুরদের দোষও কম ছিল না। কোনও জায়গায় হয়তো ঋষিরা মন দিয়ে যজ্ঞ করছেন। কোত্থেকে একটা কুকুর এসে যজ্ঞের ঘি খানিকটা চেটে দিয়ে গেল, অথবা মুখে করে নিয়ে গেল খানিকটা পুরোডাশ। চপলমতি কুকুরের এই অবিমৃশ্যকারিতায় ঋষিরা এতটাই পীড়িত বোধ করতেন যে, কুকুরের চেটে দেওয়া ঘি তারা অপবিত্রবোধে যজ্ঞে ব্যবহার করতেন না। স্বয়ং মনু মহারাজ আবার এতটাই শঙ্কাপ্রবণ ছিলেন যে, তিনি বলেছেন–দেশ যদি অরাজক হয়, তবে সেই অরাজকতার জন্য এতটাই অমঙ্গল দেখা দিতে পারে যে, কুকুরও যজ্ঞের ঘি চেটে দেবে, কাকও যজ্ঞের পুরোডাশ নিয়ে উড়ে পালাবে অদ্যাৎ কাকঃ পুরোডাশং শাবলিহাদ হবিস্তথা। কুকুরের এই হবিলেহন-প্রবৃত্তি, এবং সেই কারণেই তাদের ওপর ব্রাহ্মণ-সমাজের বিরক্তি–এই দুটিই প্রাচীনকালে প্রায় বাদিক স্তরে পৌঁছেছিল- এই কথাটি মনে রেখেই আমরা জনমেজয়ের প্রসঙ্গে আসছি।