তাছাড়া মনে রাখা দরকার, মহাভারতের যে অংশগুলি আধুনিক সমাজে নিন্দিত এবং প্রক্ষিপ্ত বলে মনে হচ্ছে, সেগুলি যদি তর্কের খাতিরে ব্রাহ্মণ্য সংযোজন বলেও মেনে নেওয়া যায়– সত্যি বলতে কি আমিও তাই মানি– তবুও প্রশ্ন থেকে যায় যে, মহাভারতের মূল অংশ কি তাহলে ব্রাহ্মণেতর অন্য কোনও জাতির লেখা? ক্ষত্রিয় বৈশ্য বা শুদ্রের লেখা? বলতে দ্বিধা নেই–এ কথা বোধহয় গবেষণার শত সূত্রেও প্রমাণ করা যাবে না। তাহলে বলি- মহাকাব্যের প্রকৃষ্ট অংশটুকু যদি ব্রাহ্মণদের লেখা হয় এবং সংযোজনগুলিতেও যদি ব্রাহ্মণদেরই কর্তৃত্ব থাকে, তাহলে সিদ্ধান্ত হয়–সমাজে মহাকবি গোছের ভাল ব্রাহ্মণও যেমন ছিলেন আবার তেমনই অকবি, স্বেচ্ছাবিহারী, স্বার্থান্বেষী ব্রাহ্মণেরাও ছিলেন। একই জাতির একটি বিশেষ গোষ্ঠীর দোষে সমগ্র ব্রাহ্মণ জাতি গালাগালি ধান কেন? মানব সমাজের মুক্তি যাদের কাছে কাম্য, তাদের কাছে নিবেদন হয় এই বিভেদ সৃষ্টির খেলা বন্ধ করুন, নয়তো ব্রাহ্মণ্য সংযোজন’–এই শব্দটির সাধারণীকরণ বর্জন করে ‘দুষ্ট ব্রাহ্মণ্য সংযোজন’ বলুন। সাধারণভাবে বললে স্বীকার করতেই হবে যে, ব্রাহ্মণরা নারী-শূদ্র বা বহু জন-জাতির প্রতি অন্যায় আচরণ যেমন করেছে, তেমনই সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভাল কাজও কিছু করেছে। তার উদাহরণ দিতে পারি ভূরি ভূরি।
থাক এসব কথা। উগ্রশ্রবা সৌতি যে মুহূর্তে মহাভারতের আখ্যান আরম্ভ করেছেন, সে মুহূর্তেই তিনি জানেন–তিনি যা বলছেন, সেই কথা-কাহিনী তার পূর্বজরা হয়তো আরও একভাবে শুনেছেন এবং আরও অন্য কোনওভাবে বর্ণনাও করেছেন হয়তো ব্যাখ্যঃ কবয়ঃ কেচিৎ। তিনি জানেন- মহাভারতের কথা ভারতের মতোই বিচিত্র এবং ততোধিক বিচিত্র এক মানবগোষ্ঠীর জীবনের প্রতিফলন। তিনি জানেন–ভারতের তথাকথিত আর্য সম্প্রদায় কোনো ভাবেই রক্তের বিশুদ্ধতা টিকিয়ে রাখতে পারে না। শত কবির দর্শন মনন এবং কখনও বা স্কুল হস্তের অবলেপও ঘটেছে এখানে। একটি বিশাল জাতির ইতিহাস কখনও কোনও একক কবির মনন-সীমায় আবদ্ধ হতে পারে না। জন-জাতির শরীরে মনে যখন যে প্রভাব এসেছে, কবিরাও তা ধরে রেখেছেন মহাকাব্য-ইতিহাসের প্যানোরমায়।
হয়তো এই কারণেই-কথাটা ভেবে দেখবেন একটু–মহাভারত বিশালবুদ্ধি ব্রাহ্মণ ব্যাসের লেখা হলেও, সে কাহিনী বৈশম্পায়নের মতো এক ব্রাহ্মণের মুখে প্রাথমিকভাবে উচ্চারিত হলেও আমরা যে কথক-ঠাকুরের মুখে মহাভারতের কথা শুনছি, তিনি কিন্তু একজন সংকরজ কবি, তিনি সূত-জাতীয়। মহাভারতের বিচিত্র সংযোজন-পর্বের নিরিখে যে সাস্কর্যের সৃষ্টি হয়েছে, সেই সাক্কর্য এই সূতজাতীয় কথক ঠাকুরের মধ্যেও আছে। হয়তো সেই কারণেই কোনও ব্রাহ্মণ নয়, ক্ষত্রিয়ও নয়, কিংবা বৈশ্যও নয়, একজন সূত-জাতীয় ব্যক্তিই মহাভারতের বক্তা নির্বাচিত হয়েছেন।
সূত কাকে বলে জানেন? প্রাচীন নৃতত্তের সূত্রে দুভাবে ‘সূত’-শব্দটির ব্যাখ্যা করা যায়। যদি মনু মহারাজকে আমরা প্রাচীন নৃতত্ত্ব অথবা জাতিতত্ত্বের প্রধান ভাষ্যকার বলে মেনে নিই, তাহলে ‘সূত’ শব্দের প্রধান ব্যাখ্যা হল–ক্ষত্রিয় বীর-পুরুষ যদি ব্রাহ্মণী বিয়ে করে বসতেন তবে তাদের ছেলেদের জাতিগত উপাধি হত সূত– ক্ষত্রিয়া বিপ্রকন্যায়াং সূতো ভবতি জাতিতঃ। মহাভারতের বক্তা সূত লোমহর্ষণকে অথবা সৌতি উগ্রশ্রবাকে যদি এই ব্যাখ্যায় বিচার করি, তাহলে বোধহয় ঠিক হবে না।
বস্তুত মহাভারত বা পুরাণের যুগে সূত বলে একটা আলাদা ক্লাসই ছিল। পুরাণগুলির মধ্যে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীতে যেদিন আমরা প্রথম রাজা পেয়েছি, সেদিন থেকে আমরা সূত’কেও পেয়েছি। পুরাণ মতে এই পৃথিবীর প্রথম সার্থক রাজা হলেন পৃথু–যার নামে এই পৃথ্বী বা পৃথিবী। তা পৃথু যেদিন জন্মালেন, সেইদিনই পিতামহ ব্রহ্ম সোমযজ্ঞের আহুতি-ভূমিতে সূত এবং মাগধদের সৃষ্টি করলেন। সমাগত মুনি-ঋষিরা সূত-মাগধদের অনুরোধ করলেন মহান পৃধুর স্তব করতে
সেই যে প্রথম সূত-মাগধেরা পৃথুর স্তব করেছিলেন, তার পর থেকেই এঁরা চিহ্নিত হয়ে গেলেন রাজবংশের কীর্তি-গায়ক হিসেবে। বিভিন্ন রাজবংশের কীর্তিখ্যাতি, মুনি-ঋষিদের আশ্চর্য সব তপশ্চর্যা– সব এই সূতেরা স্মৃতিতে ধরে রাখতেন বলেই সূতেরাই ছিলেন সে যুগের ঐতিহাসিক, যাকে তৎকালীন পুরাণের ভাষায় বলা হয় পৌরাণিক’–সূতাঃ পৌরাণিকা থোক্তাঃ।
মহাভারতে দেখবেন প্রথমেই বলা হচ্ছে লোমহর্ষণ সূতের ছেলে ‘পৌরাণিক উগ্রশ্রবা এসেছেন শৌনকের আশ্রমে লোমহর্ষণপুত্র উগ্রশ্রবাঃ সৌতিঃ পৌরাণিকো নৈমিষারণ্যে। প্রাচীন সমাজের মুনি-ঋষিরা সূতদের যথেষ্ট সম্মান করতেন, কারণ তাদের বিদ্যা-বুদ্ধি পড়াশুনো ছিল ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের মতোই গভীর–পুরাণের ভাষায়–অমলপ্রজ্ঞাঃ। যদি ধরে নিই–মনুর বিধান মতো ক্ষত্রিয়-পুরুষ আর ব্রাহ্মণী সুন্দরীর মিলনে যে সূত-জাতি তৈরি হয়েছিল, কালক্রমে তারাই পৌরাণিক, ঐতিহাসিক হয়ে গেলেন, তাহলেও বলতে হবে– রাজবংশ এবং মুনিবংশের ইতিহাসই শুধু নয়, মহাভারতের মতো বিশাল এই ইতিহাস শোনানোর জন্যও নয়, কালে কালে মহাভারতের বিভিন্ন সংযোজন-পর্ব শোনাবার পক্ষে তারাই সবচেয়ে উপযুক্ত লোক– যাঁদের ভাষ্য দেওয়ার ক্ষমতা পৃথুরাজের সময় থেকেই চিহ্নিত এবং যারা জন্মগতভাবে সংকর।