সৌতির মুখে এই কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই একটু টান-টান হয়ে বসতে হয়। আজকের গবেষকরা অনেক তত্ত্ব-তথ্য প্রয়োগ করে, মহাভারতের নানান জায়গা খুঁজে নানান অসামঞ্জস্য খুঁজে বার করেন। এই অসামঞ্জস্যের সূত্রগুলি হল–বিভিন্ন চরিত্রের বয়স, ঘটনার সময় অসময়, শব্দ-ব্যবহার, স্টাইল, ছন্দ সব কিছু।
সব বিচারের পর একেক পণ্ডিতের একেক রকম ব্যবচ্ছেদ-পর্ব শুরু হয় মহাভারতের শরীরে। কেউ বলবেন– ভীমের রক্তপান, সে যে একেবারে আদিম সমাজের প্রতিহিংসা-প্রবণতা। এই প্রবণতার সঙ্গে মহাভারতের পরিশীলিত ব্যাপারগুলি মেলে না। অতএব ওই পরিশীলিত অংশটুকু পরে লেখা হয়েছে, ওটা প্রক্ষেপ। আরেক পণ্ডিত বলবেন– মহাভারতের মূল ক্ষত্রিয়-কাহিনীর সঙ্গে মহাভারতের নানা ঋষির জ্ঞান-দান, নীতি-কথা মোটেই মেলে না– ওগুলি সব ব্রাহ্মণ্য সংযোজন অর্থাৎ প্রক্ষেপ। আরেক দল কড়া পণ্ডিত– যাঁরা মহাভারত অশুদ্ধ হলেই ভীষণ রেগে যান– তাঁরা আবার শুধু মহাভারতের জ্ঞাতিবিরোধ আর যুদ্ধ কাহিনীটুকুই ধরে রাখতে চান। সেটাই শুধু মহাভারতের শুদ্ধ কাহিনী। আর সব পরে সংযযাজিত এবং সেই সংযোজন নাকি ভার্গব বংশীয় ব্রাহ্মণদের তৈরি; ঘটা করে তার নাম দেওয়া হল ভার্গব-প্রক্ষেপ। পণ্ডিতদের বুদ্ধি-ব্যায়ামে শেষ পর্যন্ত যা দাঁড়িয়েছে, তাতে দেখা যাবে মহাভারতের মূল কাহিনী মোটেই বড় নয়। শুধু জ্ঞাতিবিরোধ, মন-কষাকষি এবং যুদ্ধ, তারপর আর সবই প্রক্ষেপ।
এইসব অসামান্য গবেষকের চিন্তা-দৃপ্ত পত্ররচনা দেখলে মনে মনে যুগপৎ প্রশংসা এবং মায়া-দুয়েরই উদয় হয়। প্রশংসা এই কারণে যে, এঁদের পড়াশুনো এবং বিদ্যার বিন্যাস-কৌশল সত্যিই অপূর্ব। আর মায়া এই জন্য যে, এঁরা কোনও কিছুই আর সামগ্রিকভাবে, স্বচ্ছ দৃষ্টিতে দেখতে পান না। সহজ জিনিসকে অনর্থকভাবে জটিল করে ফেলতে এঁরা এতই দক্ষ যে, প্রক্ষেপ-প্ৰক্ষেপ করতে করতে এরা মহাভারতের বিশাল আখ্যান-রসটাই আর অনুভব করতে পারেন না। এদের অবস্থা দেখলে একটা খারাপ কথা আমার মনে আসে যদিও সেটা সংস্কৃত নীতিশাস্ত্রের কথা। একজন রসিক-সুজন বলেছেন- কাব্যার্থ আস্বাদন করার সময় যারা শব্দের উৎপত্তি নিয়ে চিন্তা করেন, তারা আসলে শৃঙ্গারকালে রমণীর আবরণ উন্মোচনের সময় কাপড়ের দাম নিয়ে ভাবেন-নীবীমোক্ষণকালে তু বস্ত্র-মৌল্য-বিচিন্তকাঃ।
নতুন কিছু করার মতো ব্যবসায়-সম্পন্ন তথা পাটোয়ারি-বুদ্ধি-সমম্বিত এই সব পণ্ডিত-ধুরন্ধরের বক্তব্য কখনওই অকাট্য নয়; তবে তা কাটার মতো উপযুক্ত ইচ্ছা আমার কখনওই হয় না। হয় না, কারণ, আমরা জানি মহাভারতের গল্প এতই জনপ্রিয় যে, সেই জনপ্রিয়তার সুযোগে কথক-ঠাকুরদের অনেক গল্প, ঋষি-মুনিদের অনেক তত্ত্বজ্ঞান, মানুষের অনেক হৃদয়-স্পন্দন মিশে গেছে ভারত-কথার প্রবাহে। ভারত-কথা হয়ে উঠেছে মহা-ভারত।
কথক ঠাকুর সে কথা জানেন। ভারত-কথার আরম্ভেই তিনি স্বীকার করেন, আমিই কিন্তু প্রথম লোক নই যে এই কাহিনী শোনাচ্ছে। আমার আগেও কবিরা এই কথা বলেছেন, পরেও বলবেন- আখ্যাস্যন্তি তথৈবান্যে ইতিহাস মিমং ভুবি। সেই প্রাচীন কাল থেকে যে কথা গঙ্গার জলধারার মতো আজও বয়ে চলেছে, সেই জল-ধারার মধ্যে কবে কখন কোন গল্পের নদী এসে মিলল, কবে কখন কোন তত্ত্বের প্রবাহ এসে প্রবেশ করল, কখন কোন স্বার্থে স্বার্থান্বেষীর নালার জল ইচ্ছে করে গঙ্গার জলে খাল কেটে বইয়ে দেওয়া হল-গবেষণা করলে সে সবই অনেকটা স্পষ্ট করে বলে দেওয়া যেতে পারে বটে, তবে সম্পূর্ণ জলধারার। মধ্য থেকে সেই ছোট ছোট নদীর জল, নালার জল আর চেনা যাবে কি? সব রকমের জল-প্রবাহ যখন গঙ্গায় পড়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল, তখন গঙ্গা যেমন সব জলকেই নিজের পবিত্রতার মাহাত্ম্য দান করে, তেমনই প্রক্ষিপ্ত অংশগুলিও মহাভারতের বিশাল শরীরে সম্পূর্ণ আত্মীকৃত হয়ে যাওয়ার ফলে স্পষ্ট করে তাদের যেমন আর চেনাও যায় না, তেমনই মহাভারতের প্রাপ্য মর্যাদা থেকেও সেই প্রক্ষিপ্তাংশগুলিকে বঞ্চিত করা যায় না।
বস্তুত বিরাট সুরধুনী-ধারার মধ্য থেকে দুই অঞ্জলি জল তুলে নিয়ে যেমন নির্দিষ্ট করে বলা যায় না- এটা অমুক শাখা-নদীর জল অথবা তমুক শাখা-নদীর, তেমনই মহাভারতের মধ্যেও প্রক্ষিপ্ত অংশগুলিকে আমাদের পরিশীলিত গবেষণার সূত্রে অনুমান-চিহ্নিত করা যায় মাত্র, তার বেশি কিছু করা যায় না। বলা যায় না– এটা অবশ্যই প্রক্ষিপ্ত অথবা এইটাই মূলাংশ। আমার ব্যক্তিগত মত হল, মহাভারত শুনতে হলে বা বুঝতে হলে অথবা আরও স্পষ্ট করে বলা ভাল– এই ভারতকে সামগ্রিকভাবে বুঝতে হলে মহাভারত যেমনটি আছে, তেমন ভাবেই তাকে ধরা ভাল। এরমধ্যে কোনটা ব্রাহ্মণ্য সংযোজন কোনটা ক্ষত্রিয়-সংযোজন এইসব অপোদ্ধার পদ্ধতি নিয়ে যারা বেশি মাথা ঘামান জানতে ইচ্ছে করে তাঁরা কি ভারতের জনজীবনেও রক্তের বিশুদ্ধতা নিয়েও মাথা ঘামান?
মহাভারতের শরীর ব্যবচ্ছেদ করে, অথবা পরতে পরতে তার লেয়ার তৈরি করে যারা ঢাকাই পরোটায় পরিণত করেছেন, তাদের যত রাগ ব্রাহ্মণ্য সংযোজনের ওপর। বিশেষত যেখানে নারীর অধিকার খর্বিত, শূদ্রেরা নিন্দিত অথবা আচার-ব্রতের জয়গান- সেই সব জায়গা পরিশীলিত গবেষকের চোখে ব্রাহ্মণ্য সংযোজনের উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। মুশকিল হল- এগুলির কোন কোনটি যে পরবর্তীকালে সংযোজিত, আমিও মানি এবং এতদ্বারা নারী-শূদ্র এবং তথাকথিত নিম্নস্তরের জন-জাতির অধিকার যে বিপন্ন হয়েছে, তাও মানি, কিন্তু এগুলিকে শুধুই ব্রাহ্মণ্য সংযোজন বলে শুধু একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর ওপর জনরোষ তৈরি করারও কোনও অর্থ আছে বলে আমার মনে হয় না। যারা তা করছেন, তারা পূর্বতন অন্যায়ের প্রতিকার করার জন্য অন্যতর আরও এক অন্যায়ের আশ্রয় নিচ্ছেন।