সৌতি সমবেত মুনি-ঋষিদের হাত-জোড় করে নমস্কার জানালেন। বললেন, ঠাকুরদের সব কুশল তো? আপনাদের ধর্ম-কর্ম-তপস্যা ঠিক মতো চলছে তো?
ঋষিরা কুশল বিনিময় করলেন উগ্রশ্রবা সৌতির সঙ্গে। এই বিশাল যজ্ঞ চলা-কালীন যদি কোনও পৌরাণিক এসে পড়েন– এই রকম একটা প্রত্যাশার ভাবনা ঋষিদের মনে ছিল বলে তাঁরা একটা বিশেষ আসন ঠিক করেই রেখেছিলেন। মুনিরা সবাই উগ্রশ্রবাকে ঘিরে বসে পড়লে তিনিও তাঁর নির্দিষ্ট আসনে বসলেন। এত দূরের পথ বেয়ে এসেছেন, জল-মিষ্টি খেয়ে তিনি খানিক জিরোলেন। ঋষি-ব্রাহ্মণেরা যখন দেখলেন–তাঁর শ্রান্তি আর নেই, তিনি বেশ আরাম করে জমিয়ে বসেছেন নিজের আসনে–সুখাসীনং ততস্তং বৈ বিশ্রান্তমুপলক্ষ্য চ– তখন তাঁরা বললেন, কোত্থেকে আসছ, সৌতি? এতদিন কোথায় কোথায় ঘুরলে?
উগ্রশ্রবা লৌমহর্ষণি বুঝলেন, ঋষিরা গল্প শোনার জন্য একেবারে মুখিয়ে আছেন। ঋষীণাং ভাবিতাত্মনাম। তিনি বললেন–পরীক্ষিতের ছেলে মহারাজ জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞ চলছিল, ঠাকুর। আমি সেইখানেই ছিলাম। সেখানে মহর্ষি বৈশম্পায়ন ব্যাসের বলা মহাভারতের কথা শোনালেন সবিস্তারে। এতদিন সেই সব ভারত-কাহিনীই শুনলাম বসে বসে। তারপর সর্পষজ্ঞ সেরে এ তীর্থ সে তীর্থ ঘুরে পৌঁছলাম সমন্তপঞ্চকে, সেই যেখানে কৌরব-পাণ্ডবের যুদ্ধ হল–গতবানস্মি তং দেশং যুদ্ধং যত্রাভবৎ পুরা। সব দেখার পর মনে হল–একবার আপনাদের সঙ্গে দেখা করে যাই। তাই চলে এলাম।
এই দুটো কথা থেকেই উগ্রশ্রবা সৌতির গল্প বলার ক্ষমতা বোঝা যায়। উম্মুখ শ্রোতার কানে দুটো অব্যর্থ শব্দ সে ঢেলে দিয়েছে। এক জনমেজয়ের সপর্যজ্ঞ, দুই কুরু-পাণ্ডবের মহাযুদ্ধ। নৈমিষারণ্যের ব্রতক্লিষ্ট ঋষিরা অনেক দিন থেকেই জানতেন যে, মহান কৌরব-কুলে এক বিরাট জ্ঞাতি-বিরোধ ধুমিয়ে উঠছে কতকাল ধরে। কখনও কৌরবদের অবস্থা ভাল, কখনও পাণ্ডবদের–এই রকমই চলছিল। কিন্তু মাঝখানে এত বড় যুদ্ধ ঘটে গেছে, পরীক্ষিত রাজা হয়েও বেশিদিন রাজত্ব করতে পারেননি– এই সব খবর তাঁরা সবিস্তারে জানেন না। আর জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞটা তো একেবারেই নতুন খবর। অতএব উগ্রশ্রবা সৌতির কথার সূত্রপাতেই সমুৎসুক ঋষিদের শ্রবণেচ্ছা শানিত হল।
আর এই সৌতির নিজের বোধ-বুদ্ধিও কম নয়। বৈশম্পায়নের বলা কথা শুনেই তিনি সন্তুষ্ট হননি। তিনি সরেজমিনে সমন্তপঞ্চকে গিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রের পরিবেশ পরিণতি দেখতে। জায়গাটা ভাল করে দেখা না থাকলে জ্ঞানী-গুণী ঋষি-মুনির সামনে ঘটনার বিবরণ দেবেন কী করে? তাছাড়া সমস্তপঞ্চক শব্দটা উপস্থিত ঋষি-মুনিদের কানটা খাড়া করে তুলল। কারণ, এই জায়গাটা অনেক কাহিনীর আকর। সেই সমস্তপঞ্চকে আবারও একটা নতুন ঘটনা ঘটেছে– এটা শ্রোতা ঋষিদের প্রশ্রয় উদ্রেক করার পক্ষে যথেষ্ট।
ঋষিরাও বুদ্ধিমান। তাঁরা শুধু সমন্তপঞ্চকের পরিণতি শুনে বিশাল এক উপন্যাস কাহিনীর মজা নষ্ট করতে চাইলেন না। তাঁরা বললেন, ওই যে বললে, দ্বৈপায়ন ব্যাসের কাহিনী, পুরাণ-কথা। তা ব্যাসের কথা মানেই তো বেদ-উপনিষদের নির্যাস, সূক্ষ্ম তত্ত্বের কথা, যার বহিরঙ্গে ভারতের ইতিহাস, বিচিত্র উপাখ্যান– ভারতস্যেতিহাসস্য পুণ্যাং গ্রন্থার্থসংযুতাম।
আসলে ঋষিদের মনে একটা পাপবোধ কাজ করছে। তাঁরা যজ্ঞ করতে এসেছেন। তাঁদের মনটা সদা সর্বদা যজ্ঞ অথবা যজ্ঞাঙ্গীয় কাজেই ব্যাপৃত রাখার কথা। কিন্তু যজ্ঞের প্রাত্যহিক পৌনঃপুনিকতা এধং অবসর তাঁদের ঠেলে দিয়েছে অভিনব কাহিনীর সন্ধানে। কিন্তু কাহিনী, আখ্যান-উপাখ্যান যদি ব্যাসের লেখা হয়, তবে তাঁদের বিরাট সুবিধে। যে মহাকবি চতুর্বেদের বিভাগ করেছেন, অষ্টাদশ পুরাণ লিখে তবে মহাভারত লিখতে বসেছেন, তিনি যে বেদ-উপনিষদ-পুরাণ উলটে দিয়ে শুধুই প্রাকৃতজনের গল্প-কথা বলে যাবেন না, সে কথা নিশ্চিত। ঋষিদের এইটাই বাঁচোয়া। যজ্ঞ-কার্যহীন একটা সময়েও তাঁরা বৃথা সময় কাটাচ্ছেন না–তাঁরা এমন একটা কাব্য-ইতিহাস শুনতে চাইছেন, যার মধ্যে পাপনাশিনী ধর্মকথাও যেমন আছে, তেমনই আছে বেদের হবির্গন্ধ এবং উপনিষদের শান্ত জ্ঞান- সূক্ষ্ণার্থন্যায়যুক্তস্য বেদার্থৈভূষিতস্য চ।
ঋষিরা বললেন– তুমি আরম্ভ করো, সৌতি। আমরা শুনতে চাই দ্বৈপায়ন ব্যাসের লেখা সেই কাহিনী। অদ্ভূত তাঁর ক্ষমতা, যিনি মহাভারতের মতো বিশাল গ্রন্থ রচনা করেছেন– ব্যাসস্য অদ্ভুতকর্মণঃ। মহারাজ জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে গিয়ে বৈশম্পায়নের মুখে সেই কাহিনীই তো তুমি শুনে এলে– জনমেজয়স্য যাং রাজ্ঞো বৈশম্পায়ন উক্তবান্। আরম্ভ করো তুমি।
.
০২.
সৌতি উগ্রশ্রবা এবার কথক-ঠাকুরের নিয়ম-কানুন মেনে–তাঁর গাওনা যাতে ভাল হয়, যাতে নির্বিঘ্নে মহাভারতের বিচিত্র পদ-পর্বগুলি শ্রোতার সামনে একের পর এক তিনি পরিবেশন করতে পারেন, তার জন্য পরম ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করে বললেন–
শুনুন তাহলে ঋষি-ঠাকুররা। এই জগতের আদি পুরুষ ভগবান শ্রীহরিকে নমস্কার। অদ্ভুতকর্মা দ্বৈপায়ন ব্যাসের লেখা মহাভারতের কথা বলব আমি। তবে দেখুন–আমিই কিন্তু সেই প্রথম লোকটি নই যে এই কাহিনী প্রথম বলছে। আমার আগেও অন্য কবিওয়ালারা এই কাহিনী বলে গেছেন, আমার সমসাময়িকেরাও বলছেন– আচখ্যুঃ কবয়ঃ কেচিৎ সম্প্রত্যাচক্ষতে পরে– আবার ভবিষ্যতেও অন্য কবিরাও আমারই মতো এই মহাভারতের ইতিহাস বলবেন।