এইভাবে কৃষ্ণের প্রতিষ্ঠা করার জন্য দার্শনিকরা তাদের বিচার আরম্ভ করেছেন একেবারে উপনিষদের বাক্য-মহাবাক্য থেকে। রসো বৈ সঃ–এইসব কথা তো আছেই, রসিক জনেরা যুক্তি দিয়ে বৃহদারণ্যক উপনিষদের পংক্তি উদ্ধার করে বলেন–পরম পুরুষ নাকি তার জ্যোতিলোকে একা একা বসে আর সুখ পাচ্ছিলেন না, কারণ, একা একা কি সুখ পাওয়া যায়–স বৈ নৈব রেমে, যস্মন্ একাকী ন রমতে? তিনি তাই আপন স্বরূপস্থিত রস আস্বাদনের জন্য অদ্বৈত সত্তা পরিত্যাগ করে দুই হলেন, স্বামী হলেন, স্ত্রী হলেন ইত্যাদি।
কৃষ্ণের ক্ষেত্রে অবশ্য স্বামী-স্ত্রীর এই দ্বৈত রসাস্বাদনের ভূমিকাও ম্লান হয়ে গেছে। দার্শনিকেরা বলেছেন–স্বামী-স্ত্রীর প্রেমের মধ্যে যে বৈধতা আছে, যে নিয়ম আছে, একপত্নীকতার মধ্যে যে ব্রত আছে, তা কখনও পরম ঈশ্বরকে তৃপ্ত করতে পারেনি। সে প্রেমের যে তৃপ্তি, তার পরীক্ষা হয়ে গেছে রামচন্দ্রের অবতারেই। অতএব চরম রসাস্বাদনের জন্য চাই চরম প্রেম–যে প্রেমের মধ্যে সতত বাৰ্যৰ্মানতা আছে, যে প্রেম সমস্ত সামাজিক শৃঙ্খল, বাধা-নিয়ম অতিক্রম করে পরম কান্তের দিকে ধাবিত হয়, সেই প্রেম আস্বাদনের উদ্দেশ্য নিয়েই কৃষ্ণের মর্ত্যভূমিতে অবতরণ ঘটেছে।
তবে এই অবাধ অবৈধ প্রেমের কথা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে দার্শনিকেরাও ভয়ঙ্কর রকমের সাবধান হয়ে গেছেন। এ প্রেম যে সাধারণ মানব-মানবীর প্রেম নয়, এবং এ প্রেম যে সাধারণ মানব-মানবীর অনুকরণীয়ও নয়–সে ব্যাপারে তাদের সতর্কবাণীরও অন্ত নেই। দার্শনিক দিক দিয়ে পরম ঈশ্বর কৃষ্ণ যখন শত-সহস্র ব্রজগোপীর প্রেমপাশে আবদ্ধ হবেন, তখন সেই ব্রজগোপিনীদের স্বরূপ মোটেই সাধারণ হবে না। ওঁরা এক্ষেত্রে একটি পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করে বলেন–কায়্যুহ। অর্থাৎ এই যে শত শত ব্রজরমণীরা আছেন, তারা সব পরম ভগবান কৃষ্ণের স্বরূপ। ভগবান কৃষ্ণ তার একান্ত অন্তর্গত রস আস্বাদনের জন্যই তাদের সৃষ্টি করেছেন নিজেরই স্বরূপ থেকে। যিনি নিজে নিজের মধ্যেই পরম রসাস্বাদন করতে পারেন, যিনি আত্মারাম, তিনি নিজের সেই রসস্বরূপটি পরম এবং চরমভাবে আস্বাদনের জন্যই শত-সহস্র গোপিনীর সৃষ্টি করেছেন। আর তাঁর এই লীলা-আস্বাদনে সহায়তা করছেন ভগবতী যোগমায়া। সাধারণ মায়া যেমন মানুষকে ভুলিয়ে মোহগর্তে নিক্ষেপ করে, যোগমায়া তেমনি ভগবানের ভগবত্তা ভুলিয়ে সাধারণ মানুষের মতো রস আস্বাদনে সাহায্য করেন। কারণ ভগবানের যদি পদে পদে খেয়াল থাকে যে, তিনি ভগবান, তাহলে আর তার বনতলে জ্যোৎস্নারজনীতে রাধার নামে বাঁশী বাজিয়ে বারবার প্রেমের ডাক পাঠাবার মানে থাকবে না। অতএব যোগমায়া তাকে তার ভগবদস্বরূপ ভুলিয়ে দেন, আর তিনি প্রেমে উন্মত্ত হন আপন-সৃষ্ট সহচরীদের সঙ্গ-রঙ্গ উপভোগ করার জন্য।
কৃষ্ণপ্রেমের দার্শনিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমি লেখনীধারণ করিনি, কারণ আমার লেখনী সেখানে অপ্রতুল, ক্ষমতা সীমিত। আর সেই দার্শনিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার উপযুক্ত স্থানও এটা নয়। আমরা কৃষ্ণ-জীবনের ঐতিহাসিকতার বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু তবু এই দার্শনিক তত্ত্বের সামান্য সূত্রটুকু এইজন্য দিলাম যে, এও আমাদের সেই ভণিতার অঙ্গ। যাঁর প্রেম-কাহিনী উপজীব্য করে শত শত দার্শনিক গ্রন্থ লিখতে হয়েছে, যে প্রেমের প্রতিষ্ঠার জন্য মহামতি চৈতন্যদেব এবং তাঁর প্রবর্তিত বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত শত শত মহাসত্ত্ব ব্যক্তি সারা জীবন অতিবাহিত করেছেন, তার উল্লেখমাত্র না করে আমরা কৃষ্ণজীবনের ঐতিহাসিকতায় প্রবেশ করব, সে একরকম বাতুলতা। কিন্তু এই দার্শনিক সূত্র তথা মিথলজির সূত্র ধরে যত জ্ঞানই বিকিরণ করা যাক, আমাদের উদ্দেশ্য কিন্তু একটাই। ব্রজের পোপবৃদ্ধদের সঙ্গে কৃষ্ণের প্রিয়ত্ব সম্বন্ধ নয়, শত শত গোপজনের সঙ্গে কৃষ্ণের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধও নয়, বৃন্দাবনের গোপিনী-আহিরিণীদের সঙ্গে কৃষ্ণের যে প্রণয় ছিল, প্রেম ছিল, শারীর-সম্বন্ধ ছিল–সেই সম্বন্ধের ঐতিহাসিক স্থাপন করাই আমাদের উদ্দেশ্য।