উপরিউক্ত স্তুতি পংক্তির মধ্যে যে সমস্ত রমণীর উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের সঙ্গে অ্যাপোলোর নৃত্য-গীত বৈধ হয়েছে না অবৈধ হয়েছে, সে তর্কে আমরা যাচ্ছি না। কিন্তু বৃন্দাবনে যে সমস্ত রমণীদের সঙ্গে কৃষ্ণের সংসর্গ এবং মিলন হয়েছিল, তারা আপাতদৃষ্টিতে পরস্ত্রী হলেও তাদের প্রেম এবং ভালবাসা এমনই উচ্চস্তরে পৌঁছেছে যে তা দর্শন এবং রসশাস্ত্রের বিশেষ বিচারণীয় বিষয় হয়ে পড়েছে।
ওদেশে অ্যাপোলোর যে বীরত্বের, প্রেমের যে নিদর্শন পেলেন আমাদের দেশে সৌরকক্ষের প্রধান দেবতা ইন্দ্রের মধ্যেও সেই নিদর্শন পাবেন। ঋগবেদ থেকে আরম্ভ করে পুরাণগুলিতে ইন্দ্রের দেবরাজের ভূমিকা তথা বীরের মহিমা যেমন প্রতিষ্ঠিত, তেমনি তার প্রেমের কথাতেও বেদ-পুরাণ ছেয়ে গেছে। শুধু প্রেমই বা বলি কেন, তার চরিত্রে অবৈধ অপপ্রেমের কলঙ্কও কিছু কম নয়। অহল্যা ইত্যাদি রমণীর প্রতি তার অজিতেন্দ্রিয় ব্যবহারও অপ্রসিদ্ধ নয়। পণ্ডিতজনেরা বলেছেন–ইন্দ্ৰ-পূজার সঙ্গে কৃষ্ণপূজার বিরোধ ঘটার পর ইন্দ্রের যজ্ঞ স্তব্ধ হয়েছিল এবং গোবর্ধন পর্বতের পাদদেশে কৃষ্ণের সর্বাধিনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ইন্দ্রের নায়কত্বের বিরুদ্ধেই। কিন্তু মিথলজির জগতে দুই দেবতার এই বিরুদ্ধতা চিরস্থায়ী হয় না। পুরাণ-কাহিনীতে ইন্দ্ৰ হেরে গিয়ে কৃষ্ণের সঙ্গে আপস-মীমাংসা করে নিলেন বটে, কিন্তু মিথলজির জগতে এই আপসের ফল হয় উলটো রকম।
মিথলজিস্টরা বলেন ঋগবেদে বিষ্ণুর যে পরিত্রাতার ভূমিকা আছে, সেই পরিত্রাতার স্বরূপ কৃষ্ণের মধ্যে থাকায় ভগবান বিষ্ণু কৃষ্ণের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে গেছেন। তবে বিষ্ণুর সঙ্গে কৃষ্ণের এই মেশামেশি বা স্বরূপ বিপরাবর্তনের ঘটনাটা ঘটেছে কৃষ্ণের পরবর্তী জীবনকে কেন্দ্র করে। পাণ্ডব-ভাইদের সঙ্গে কৃষ্ণের দেখা হওয়া থেকে একেবারে ভারতযুদ্ধ পর্যন্ত কৃষ্ণ এমনই এক পরিত্রাতার ভূমিকায় ছিলেন এবং সেই পরিত্রাণের মাহাত্ম্য এতটাই যে কৃষ্ণ সহজেই বৈদিক বিষ্ণুর পরিত্রাতার ভূমিকাটি আত্মসাৎ করে ফেললেন। কোনও কোনও পণ্ডিত অবশ্য এমনও বলেছেন–যে, কৃষ্ণের সর্বাতিশায়ী মাহাত্ম্য-গুণে স্বয়ং বিষ্ণুই কৃষ্ণের তত্ত্বগত স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে–বিষ্ণুর এই তত্ত্বগত দার্শনিক স্বরূপ অধিগ্রহণের ঘটনা কৃষ্ণের পরবর্তী জীবনের পরিসর।
কৃষ্ণের পূর্বজীবনে যে বৈদিক দেবতার স্বরূপ মিশে গেছে, তিনি কিন্তু ইন্দ্র। কৃষ্ণের সঙ্গে তার বিরোধ হয়েছে, আপস-মীমাংসাও হয়েছে–সবই ঠিক আছে, কিন্তু ওই যে বললাম মিথলজির জগতে তার ফল হয়েছে অন্যরকম। সময় যত এগিয়েছে, বৈদিক সমর-দেবতা ইন্দ্রের বীরত্ব, প্রেম এমনকি অপপ্রেমের ভূমিকাও মিশে গেছে কৃষ্ণের পূর্বজীবনের সঙ্গে। ঋগবেদে অসুর–দৈত্য বধের জন্য ইন্দ্র যত বিখ্যাত হয়েছেন, তেমনটি আর কেউ নয়। একইভাবে বৈদিক যুগের পরবর্তীকালে কৃষ্ণ হলেন সেই ব্যক্তি যিনি অঘাসুর, বকাসুর ইত্যাদি শতেক রকমের অসুর-দৈত্য বধের জন্য বিখ্যাত হয়েছেন। ইন্দ্র বধ করেছেন বৃত্রকে, কৃষ্ণ বধ করেছেন শম্বর নামে এক অসুরকে; ইন্দ্র কালোপম সর্পবিনাশ করে সপ্তসিন্ধুর গতি মুক্ত করলেন, কৃষ্ণ কালিয়-নাগকে দমন করে যমুনার জল পরিশুদ্ধ করে ব্রজবাসীদের কাছে তা মুক্ত করে দিলেন। ইন্দ্রের এই সব বীরত্বসূচক ঘটনা কৃষ্ণের পূর্ববর্তী জীবনের বীরত্ব-কাহিনীর ওপরে আরোপিত হতে হতে ইন্দ্রের স্বরূপটাই মিশে গেছে কৃষ্ণের পূর্ববর্তী জীবনে। কিন্তু শুধু বীরত্বই নয়, তার সঙ্গে আছে ইন্দ্রের অনিয়মিত প্রেমোন্মত্ততাও। ইন্দ্রের অতিরিক্ত প্রেমিক স্বভাব উপযুক্ত আধার হিসেবে কৃষ্ণের মধ্যেই সংক্রামিত হয়েছে। প্রেমের ক্ষেত্রে তথাকথিত রিরংসা, নীতি-বহির্ভূত স্ত্রী-সম্ভোগ তথা মুহূর্মুহূ প্রেমে পড়ার প্রবণতা এবং পটুতা কৃষ্ণের বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত এবং পণ্ডিতেরা মনে করেন কৃষ্ণের এই উত্তরাধিকার এসেছে সৌর-দেবতা ইন্দ্রের সাজাত্যে।
মিথলজিস্টরা যা বলেন বলুন–কৃষ্ণের প্রেমস্বভাব নির্ণয়ে মিথলজির বিশাল তর্ক-যুক্তি ভেসে গেছে দার্শনিকদের তাত্ত্বিক গাম্ভীর্যে। এমনকি অবতার পুরুষ হিসেবে সাধারণ পরিত্রাতার যে ভূমিকা থাকে দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন পদ্ধতিতে, সেই পদ্ধতিও এখানে গৌণ হয়ে গেছে। বৈষ্ণব দার্শনিকেরা কৃষ্ণকে প্রতিষ্ঠা করেছেন তাদের দার্শনিক ভাবনার চরম বিন্দুতে। কৃষ্ণ সম্পূর্ণভাবেই এখানে নরলীলা অর্থাৎ মানুষ হিসেবে তিনি লীলা করলেও তিনি কিন্তু পরমার্থতত্ত্ব। কংস-শিশুপাল বধ করে অথবা ভারতযুদ্ধে ধর্মের প্রতিষ্ঠা করে তিনি যা করেছেন, তা সামান্যভাবে তার অন্তরশায়ী বিষ্ণুর পরিত্রাতার ভূমিকা, এখানে তার কোনও ভূমিকাই নেই। দার্শনিকেরা বলেছেন স্বয়ং ভগবান যখন পূর্ণ অবতার গ্রহণ করেন, তখন অন্যান্য দেব-স্বরূপ তার সঙ্গে এসে মিশে যায়। অতএব কংস-শিশুপাল বধের ক্ষেত্রে বিষ্ণুই সে ভূমিকা পালন করেছেন, আসলে কৃষ্ণের কাজই ওটা নয়।
তাহলে অবতার হিসেবে কৃষ্ণের কাজটা কী, যার জন্যে তাকে নরলীল হয়ে এই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হতে হল? দার্শনিকরা বলেছেন–কৃষ্ণ অবতারের প্রধান উদ্দেশ্য হল রস আস্বাদন। তার নিজের ভিতরেই যে অনন্ত রস আছে, তা নিজে নিজেই অনুভব করা যায় না। নিজের রসস্বরূপতা বোঝবার জন্যও আরও একটি সত্তার প্রয়োজন। সেই রস-সত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্রজের রমণীদের মধ্যে। আর রসিক হিসেবে তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন সেই রস-সত্তা আস্বাদনের জন্য।