একটা কথা মনে রাখুন, শিশুপাল কৃষ্ণের আপন পিসির ছেলে, যে কোনও কারণেই হোক, নিজের উচ্চাশার কারণে তিনি মগধরাজ জরাসন্ধের দক্ষিণ-হস্ত হয়ে উঠেছিলেন। সে সব কথা আমরা পরে বলবও। কিন্তু এটা বোঝা দরকার কৃষ্ণের সঙ্গে শিশুপালের সম্বন্ধ অত্যন্ত নিকট বলেই, তথা তিনি তার ওপরে অত্যন্ত বিদ্বিষ্ট বলেই কৃষ্ণের পূর্বজীবন সম্বন্ধে তিনি সত্য কথা বলবেন। গোপজাতির মধ্যে কৃষ্ণের বাল্যকাল কেটেছে, এবং তিনি যে পুতনা-বধ, গোবর্ধন ধারণ ইত্যাদি কর্ম করে গয়লাদের মধ্যে যথেষ্ট নামও কিনেছিলেন এক সময়ে, সে সম্বন্ধেও শিশুপালের সব জানা আছে এবং সে সব ঘটনা সম্বন্ধে তার বক্তব্যও আছে।
শিশুপাল বলেছেন–শুনি নাকি শিশু বয়সে কৃষ্ণ পুতনা নামে একটি শকুনিকে মেরেছিল, তা তাতে আশ্চর্যের কী আছে–যদ্যনেন হতা বাল্যে শকুনিশ্চিমত্র কি? পুরাণগুলিতে পুতনা কোথাও বালক-ঘাতিনী রাক্ষসী, কোথাও কংসের চর, কোথাও বা শকুনি মানে একটি পাখি মাত্র। শিশুপাল কৃষ্ণের বীরত্ব খাটো করার জন্য পুতনাকে একটি পক্ষী-মাত্র বলবেন, তেই বা আশ্চর্যের কী আছে। কংসপ্রেরিত ঘোটকাসুর, কী বৃষভাসুর যত বড় শক্তিশালী মানুষই হোন, শিশুপালের কাছে, তারা ঘোড়া-ষাঁড় ছাড়া কিছু নয়। এমনকি কৃষ্ণের হাতে মারা যাওয়া সেই গাড়ি-দৈত্য শকটাসুরও একটা সামান্য খেলনা-গাড়ি ছাড়া কিছু নয় শিশুপালের কাছে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হল–পুরাণগুলিতে যে সব ঘটনা সবিস্তারে বর্ণিত এবং যা কৃষ্ণের পুর্বজীবনের ঘটনা, হীনতাসূচকভাবে হলেও আমরা তার উল্লেখ পাচ্ছি মহাভারতে।
গোবর্ধন পাহাড়ে ব্রজবাসীদের আশ্রয় বিধান করে কৃষ্ণ যে বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিলেন, সে বুদ্ধিটাও শিশুপালের মুখে হয়েছে এইরকম–আরে–উইয়ের ঢিবির মতো গোবর্ধন পাহাড়টা নাকি এ ব্যাটা হপ্তাখানেক মাথার ওপরে তুলে রেখেছিল–বল্মীকমাত্রঃ সপ্তাহং যদ্যনেন ধৃতোচলঃ–তা, এতে আমার আশ্চর্য হবার কিছু নেই বাপু। এমনকি পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে গয়লাদের দেওয়া রাশি রাশি খাবার যে খেয়েছিল কৃষ্ণ, তাতে অন্য লোকেরা আশ্চর্য হয় হোক–আমার তাতে কিছু যায় আসে না। সব শেষে বলি–কংসকে নাকি এই কৃষ্ণ মেরেছে শুনি। তাতেও এমন কিছু ভয়ের কথা নেই, সে কথা অদ্ভূতও কিছু নয়–স চানেন হতঃ কংস ইত্যেতন্ন মহাদ্ভুতম্।
বস্তুত তখনকার দিনের সর্বাধিনায়ক জরাসন্ধের তুলনায় শিশুপাল কংসকে খুবই ছোট করে দেখলেও আমাদের কোনও ক্ষতি নেই আপাতত। এমনকি কৃষ্ণকে খাটো করলেও আমরা আপাতত শিশুপালের ওপর অসন্তুষ্ট নই। কিন্তু শিশুপাল কৃষ্ণের পূর্বজীবন সম্বন্ধে, বিশেষত তাঁর বৃন্দাবন-বাসকালীন ঘটনাগুলি সম্বন্ধে যে কথাগুলি বললেন সেগুলি কোনও-না কোনওভাবে সত্য বলেই পুরাণগুলিতে স্বীকৃত এবং সেগুলি সূত্রাকারে মহাভারতেও উল্লিখিত হল। সূত্রাকারে এইজন্য যে, এখানে বৃষ্ণি-অন্ধকদের কীর্তি-খ্যাতি মূল বর্ণনার বিষয় নয়। পাণ্ডব-কৌরবরাই মহাভারতের মুখ্য চরিত্র। কিন্তু কৃষ্ণের পূর্ব–জীবনের কাহিনী মহাভারতে কিছুই নেই-নেই বলে যারা ধুয়া তোলেন, সেই সমস্ত পণ্ডিতজনের স্বাত্মপ্রমোদিনী গবেষণায় আমাদের আপত্তি আছে। আপত্তি সেই সব প্রক্ষেপবাদী পণ্ডিতজনের সম্বন্ধেও যাঁরা কম্বলের লোম বাছতে বাছতে মহাভারতের মতো অত্যুষ্ণ কম্বলখানিকেই ঝাঁঝরা করে দিয়েছেন।
পুতনা, অশ্বাসুর, বৃষভাসুর, গোবর্ধন-ধারণ এমনকি গোবর্ধন পাহাড়ে সেই রাশীকৃত অন্নকূটের কথাও যেখানে মহাভারতে উল্লিখিত হল, সেখানে হরিবংশ এবং পুরাণগুলির বিস্তারিত কাহিনীগুলি অবিশ্বাস করি কোন সাহসে! তার ওপরে কৃষ্ণ যে এই সেদিনও গয়লা ব্রজবাসীদের একজন ছিলেন–শিশুপালের ভাষায় সাধারণ গোপমাত্র–এবং সেই অনভিজাত ব্যক্তিটির বিরাট রাজনৈতিক সত্তা মেনে নিতে শিশুপালের যে কষ্ট হচ্ছে–সেই কষ্ট থেকেই আরও প্রমাণিত হয় যে, কৃষ্ণ গোপজনের আপনজন ছিলেন। আর শিশুপালের বক্তব্য মেনে আমরা গোপজনের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেব, অথচ গোপী-গোপিনীর অস্তিত্বে সংশয়িত হব, তা তো হয় না। অতএব গোপজনেরা যেমন বৃন্দাবনে আছেন, তেমনই আছেন আহিরিণী গোপিনীরা। তাদের সঙ্গে কৃষ্ণের সম্বন্ধটাও আমাদের একটু দেখে নিতে হবে।
কিন্তু ওই যে বলেছি, এই গূঢ় সম্বন্ধে প্রবেশ করার আগে সেই সম্বন্ধের যথার্থতার প্রমাণ দিয়ে ভণিতা না করে উপায় নেই। আমরা সে ভণিতা করেওছি খানিকটা কিন্তু আরও কিছু বাকি আছে। আমরা কোনও তত্ত্বগত সিদ্ধান্ত করার আগে আধুনিক মিথলজিস্টদের বক্তব্যটা একটু জানিয়ে দিই। মিথলজিস্টরা বলেন–সৌর বংশলতায় যে সব দেবতার জন্ম হয়েছে, অর্থাৎ যাঁদের আমরা Solar gods বলি–সেই সব দেবতাদের চরিত্রের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হল–তারা যেমন মহাবীর হন, তেমনি ভীষণ প্রেমিক হন তারা। বীরের ধর্ম এবং ভালবাসার ধর্ম দুটোই তাঁদের এত ভাল আয়ত্ত যে, পারিপার্শ্বিক জনেরা তথা স্তুতিগায়ক কবিরা তাদের বীরত্ব এবং হিতকারিত্বের নিরিখে তাদের প্রেমটাকে রীতিমতো প্রশ্রয় দেন।
আপনারা মহান গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর কথা স্মরণ করুন। তিনি সৌরকক্ষের দেবতা এবং সূর্যের আপন স্বরূপ। এই অ্যাপোলোর সঙ্গে কৃষ্ণের ভীষণ রকমের মিল। বৈধ এবং বিবাহিত প্রেমের ক্ষেত্রেই হোক, আর তথাকথিত অবৈধ রোমান্সের ঘটনাই হোক গ্রিসদেশীয় অ্যাপোলো যেমন মোহন প্রেমিক, ঠিকই তেমনি আমাদের অখিলরসামৃতমূর্তি কৃষ্ণ। স্বামী-পরায়ণা বিবাহিতা স্ত্রী হিসেবে কৃষ্ণ-প্রেয়সী রুক্মিণীর যেমন নাম, গ্রিক-সূর্যের তেমন স্ত্রী হলেন লুকোথ। আবার কৃষ্ণের যেমন নেই নেই করেও আট-আটটি পাটরানী, অ্যাপোলোর তেমন স্ত্রী আছেন ড্যাফেন অথবা বিওবিস, কীরেনি অথবা করোনিস। আর সেই শারদ রাত্রিতে কৃষ্ণ যখন তার ভালবাসা জানাতে বৃন্দাবনের সুন্দরীদের কথা স্মরণ করলেন, তখন মহামতি হেসিয়ড স্মরণ করলেন আইওনিয়ান যুবক-যুবতীদের কথা-স্মরণ করলেন অ্যালোলোর সঙ্গে মিউজদের মনোহরণ নৃত্যগীতের কথা। রাসনৃত্যের বর্ণনানিপুণ কবি শুকদেবের রাসস্তুতির সঙ্গে হেসিয়ডের নৃত্যস্তুতির পার্থক্য শুধু ভাষার। তিনি লিখেছেন–There the long-robed Ionians gather in your honour with their… shy wives, the girls of Delos, hand-maidens of the Far-shooter, Shall I sing of you as wooer in the fields of love, How you went wooing the daughters of Azan. (Hesiod, Theogony)