এই অনুকৃত রাসনৃত্যের সঙ্গে যে গান আছে, সেই গানের কথা আপনাদের বস্ত্রহরণের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। গানের শব্দ জানিয়েছে–কেমন করে মায়োন কিশোরী নপ্পিনাই-এর কাপড় আর গয়না চুরি করেছিল আর এই ঘটনায় নগ্না-নপ্পিনাই-এর লজ্জারুণ মুখের কথাটিও গান করে বলে মাদুরাইয়ের রমণীরা। ভাগবতে যাঁরা–হেমন্তে প্রথম মাসি নন্দব্রজ-কুমারিকা স্মরণ করে বস্ত্রহরণের বৃত্তান্ত শুনবেন, তাদের পক্ষে এই নাপ্পিনাই বা গোপাঙ্গনানাঞ্চ দুকূল চৌরং কৃষ্ণকে চিনতে কোনও অসুবিধে হবে না।
সত্যি কথা বলতে কি, একটা কিছু অবশ্যই ঘটেছিল সেই শরৎকালের জ্যোৎস্না-রাতে সেটা ভাগবত–পুরাণেও বর্ণিত সালংকার কোনও রাসনৃত্য নাই হোক, কিন্তু বৃন্দাবন শব্দটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই যে সেখানে এক রসরাজ পুরুষের সঙ্গে রসতীর সঙ্গ-রঙ্গ মাথায় আসে, তা তো কালিদাসও প্রমাণ করে দিয়েছেন। ময়ূরপুচ্ছ শোভিত সেই গোপ যুবককে তো তিনি ভালভাবেই চিনতেন–বর্হেণেব স্ফুরিতরুচিনা গোপবেশস্য বিষ্ণোঃ–কিন্তু রাধা-কৃষ্ণের কেলিভূমি বৃন্দাবনকে খ্রিস্টিয় চতুর্থ–পঞ্চম শতাব্দীতেই তিনি কামনার মোক্ষধাম হিসেবে কল্পনা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, বৃন্দাবন কোনও সাধারণ ক্ষেত্র নয়; এটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেই বিশালবুদ্ধি রসিক পুরুষের জীবন।
কালিদাস তাঁর স্বয়ম্বরা নায়িকাকে উপদেশ দিয়ে বলছেন–এই শূরদেশের রাজা সুষেণকেই তুমি বেছে নাও, তারপর ঠিক কুবেরের বাগানের মতো সুন্দর সেই বৃন্দাবনের বনে প্রবেশ করে আপন যৌবন সফল করো–বৃন্দাবনে চৈত্ররথাদনে নির্বিশ্যতাং সুন্দরি যৌবনশ্রীঃ। একই সঙ্গে, একই শ্লোক পংক্তিতে শূরদেশ আর বৃন্দাবনের সহাবস্থান ঘটিয়ে কালিদাস বুঝিয়ে দিলেন যে, সেই প্রাচীন কালে শূরবংশের অধস্তন কৃষ্ণ আর বৃন্দাবনের যৌবন-রসিক কৃষ্ণ পৃথক কোনও ব্যক্তি নন। পুরাণের কবি ও তাঁর রাসরসিক কৃষ্ণকে বর্ণনা করেছেন শৌরি বলে অর্থাৎ শূরদেশের মানুষ বলে, শূরবংশের অধিনায়ক বলে–তাসামাবিরভূচ্ছৌরিঃ স্ময়মান-মুখাম্ভোজঃ। কালিদাসের সুষেণ যদি শূরদেশ থেকে বৃন্দাবনে যেতে পারেন যৌবনের সাফল্য কামনায়, সেখানে মহারাজ শূরের নাতি বসুদেব-পুত্র কৃষ্ণই যে বৃন্দাবনে গোপ রমণীদের সঙ্গে তার যৌবন সফল করেছেন–সে কথা ঐতিহাসিকভাবেই প্রমাণ করা যায়।
.
১২১.
আসলে মহাভারতের সমস্ত ক্রিয়াকর্মগুলির মধ্যে কৃষ্ণের এমন একটা ঠমক-গমক আছে, তার প্রত্যেকটি উপস্থিতির পিছনে এমন সব রাজনৈতিক গভীরতা আছে যে, সেই কৃষ্ণ যে কখনও নৃত্য-গীতে মত্ত হতে পারেন, সেই কৃষ্ণ যে কখনও শারদ জ্যোৎস্নায় অভিভূত হতে পারেন, সে যেন ভাবাই যায় না। বিলাসে অনভিজ্ঞ কতগুলি গোপরমণীর রসবত্তায় মহাভারতের সূত্ৰধার সেই বীরপুরুষ যে এমন ভেসে যেতে পারেন, কঠিন-হৃদয় পণ্ডিতজনের ভাবনায়ও তা কখনও আসে না। তার ওপরে আছে ভগবদ্গীতার গাম্ভীর্য। অমন গম্ভীর তত্ত্বকথা যাঁর মুখ দিয়ে বেরতে পারে, তিনি কখনও সরলা রমণীদের সহজ ভালবাসায় ভুলে যাবেন, তা কী করে হবে!
দেখুন, বৃন্দাবন জায়গাটা তখনকার দিনের রাজা-রাজড়ার কাছে যে খুব একটা আকর্ষণীয় ছিল না, সে কথা বলাই বাহুল্য। সেখানকার মানুষজন এবং তাদের সঙ্গে বাস করাটাও যে অভিজাত পুরুষদের কাছে বেশ ঘৃণ্য ছিল সেটাও আমরা মেনে নিতে পারি। মহাভারতের উদাহরণ না হলে তো পণ্ডিতদের চলে না, তাই বলছি মহাভারতেও এমন প্রমাণ আছে যেখানে কৃষ্ণের পূর্বজীবন সম্বন্ধে অবহিত পুরুষের পক্ষে মহান মহাভারতীয় কৃষ্ণের আকস্মিক গৌরব মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের শেষে যুধিষ্ঠির যখন কৃষ্ণের উদ্দেশে অর্ঘ্য প্রদান করলেন, তখন প্রবল প্রতাপান্বিত মগধরাজ জরাসন্ধ মারা গেছেন। তার অবর্তমানে কৃষ্ণের পূর্ব-কূটচারিতায় ক্ষুব্ধ শিশুপাল কৃষ্ণের পূর্বজীবনের নীচ-সহবাসের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাকে গালাগালি দিয়ে বলেছিলেন–আমাদের মহারাজ জরাসন্ধ এই কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজের রাজসম্মান খোয়াতে চাননি। কৃষ্ণ যে দাসদের ঘরের ছেলে, ওদের সঙ্গে যুদ্ধ করাটা কি আর রাজাধিরাজ জরাসন্ধের পোষায়–যোনেন যুদ্ধং নেয়েষ দাসোয়ম্ ইতি সংযুগে।
কৃষ্ণকে এইভাবে দাস বলে সম্বোধন করার পিছনে শুধুমাত্র শিশুপালের হিংসা কাজ করছে, তা নয়। সামাজিক দিক থেকে চতুর্বর্ণের মধ্যে শূদ্রদের অবস্থান স্বীকৃত হলেও চতুর্থ বর্ণ হিসেবে তাদের সম্মান বড় ছিল না। শূদ্রদের অনেক ক্ষেত্রেই দাস সম্বোধন করাটা অভ্যাসের মধ্যে ছিল এবং গোপালক আভীর-জাতির সম্মান শূদ্রদের চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। শিশুপাল কৃষ্ণের পূর্বাবাস জানতেন বলেই তাকে দাস বলে দেখাতে চেয়েছেন। তাঁর ক্রোধ খরতর হয়ে উঠেছিল যখন কুরুবৃদ্ধ ভীষ্ম কৃষ্ণের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। কিন্তু এই সময়ে প্রতুত্তরে গালাগালি দেবার সময় শিশুপালের মুখে কৃষ্ণের বৃন্দাবনী ঘটনা একটার পর একটা উল্লিখিত হয়েছে। পণ্ডিতজনের তবু বিশ্বাস হয় না আর বিশ্বাস না করার জন্য তাদের চিরাচরিত প্রক্ষিপ্তবাদ তো আছেই।
শিশুপাল বলেছিলেন–কৃষ্ণের প্রশংসা করতে গিয়ে তোমার যে কেন জিভ খসে পড়ছে না, আমি তাই ভেবেই অবাক হচ্ছি। বলি, ছেলেমানুষেরা পর্যন্ত যার নাম শুনলে নিন্দে করবে, সেখানে তুমি একটা বুড়ো মানুষ হয়ে একটা গয়লার প্রশংসা শুরু করেছ–তমিমং জ্ঞানবৃদ্ধঃ সন্ গোপং সংস্তোতুমিচ্ছসি।