এই তেরচা করে তাকানো এবং মুখ লুকিয়ে হাসার মধ্যে যে অসাধারণ ব্যঞ্জনা আছে, তা প্রকাশ করলে দাঁড়ায় সেই সময়ে ব্রজরমণীদের সঙ্গে কৃষ্ণের সরস অভিসন্ধিগুলি আরম্ভ হয়ে গেছে ভালভাবেই। স্নেহময়ী যশোমতী সে সব যৌবনের অভিসন্ধিগুলি মাথায় না রেখে এখনও কৃষ্ণকে বালক ভাবেন বলেই যুবতীদের চাউনি এবং হাসির খোরাক জুটেছে। এই শ্লোকের মধ্যে কৃষ্ণের জীবনে গোপিনীদের সরস উপস্থিতি সালংকারে ঘোষিত হয়েছে এবং এই শ্লোকের প্রভাব কত সুদূরপ্রসারী তা বোঝা যাবে ষোড়শ খ্রিস্টাব্দে এসে। ভেবে দেখুন কত কাল পার হয়ে গেছে তবু চৈতন্য-পার্ষদ রূপ গোস্বামী হাল-সংকলিত ওই শ্লোকের মাধুর্য ভুলতে পারেননি। শ্রীরূপের লেখা বিদগ্ধমাধব নাটকের একটি সংলাপে দেখছি–কৃষ্ণ সখাদের নিয়ে কেবলই গোরু চরিয়ে ফিরেছেন। যশোদা তাকে আদর যত্ন করছেন, এমন সময় গোপরাজ নন্দ তাঁর স্ত্রীকে উদ্দেশ করে বললেন–গিন্নি! এই গোকুল বৃন্দাবনে এমন একটি মেয়ে কি খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার সঙ্গে কৃষ্ণকে বেশ মানাবে। তাহলে এবার আমি ছেলেটার বিয়ে দিতে পারি–যামুহামো বৎসম। যশোদা স্বামীর কথায় কোন গা না করেই প্রায় যুবক কৃষ্ণকে আদর করতে করতে রায় দিলেন–বাছা আমার এখনও দুগ্ধপোষ্য শিশু, ওর এখনই বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি–অঞ্জ দুগ্ধমুক বৎসল্স কো খু দানীং উব্বাহে ওসরো।
নন্দ-যশোদার এই উক্তি-প্রত্যুক্তির সাক্ষী হিসেবে এখানে ব্রজরমণীরা নেই বটে, কিন্তু কৃষ্ণের প্রাণপ্রিয় সখা, যিনি কৃষ্ণের তাল-মোল বনের সরসতার সাক্ষী, সেই মধুমঙ্গল দাঁড়িয়ে ছিলেন সামনে। তিনি যশোদার কথায় একটু ফুট না কেটে পারলেন না। বললেন–ভাই কৃষ্ণ তুমি সত্যিই দুগ্ধমুখ বালক, যে দুধের লোভে ওই গোপকিশোরীরা তোমার মুখ-চুম্বন করে বারবার।
যশোদা নিশ্চয়ই কথাটা শুনতে পাননি, কিন্তু এই সংগুপ্ত সংলাপের মধ্যে সাতবাহন হালের ছায়া আছে বটে! অজানা অচেনা অনামিকা পোপকিশোরীদের কথা রাখুন, গোপিনী-সংক্রান্ত দ্বিতীয় শ্লোকে হাল একেবারে স্পষ্টাস্পষ্টি রাধার নাম করে অদ্ভুত সুন্দর একটি লিরিকের জন্ম দিয়েছেন। কবির ভাষায়–কৃষ্ণ! তুমি যখন ফুঁ দিয়ে রাধার চোখে–পড়া ধুলি কণাটি উড়িয়ে দিতে চাইছিলে তখন অন্য ব্রজবধূদের গর্ব একেবারে ধুলোয় মিশে গিয়েছিল–মুহ-মারুণ তং কণহ গো-রঅং রাহিআত্র অবণেন্তো।
এই শ্লোক নাকি পোট্টিস বলে এক কবির লেখা। হাল তা সর্বসমক্ষে প্রকট করেছেন মাত্র। সুপ্রাচীন এই শ্লোকের ভাব-ব্যঞ্জনা বুঝতে হলে পাঠককে অন্য সাহিত্যের বর্ণনা বিশ্বাস করতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে ভাগবত পুরাণের অমানুষী ভাষায়। ভাগবতে রাস-পঞ্চাধ্যায়ীর মধ্যে একত্র দেখা যাবে কৃষ্ণ গোরমণীদের সঙ্গে রাস নৃত্যে মেতে উঠেছেন এবং সমস্ত গোপরমণীরই মনে হচ্ছে যেন কৃষ্ণ তাকেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করছেন। এই সম্মিলিত রমণীকুলের মধ্যে একজন আছেন, যাঁর এই ব্যবহার পছন্দ হচ্ছে না। কৃষ্ণ সেটা বুঝলেন খুব ভালভাবে। সেই বিশেষ রমণীকে বেশি মর্যাদা দেবার জন্য এবং অপরা গোপিনীদের গর্ব খর্ব করার জন্য কৃষ্ণ সেই বিশেষ রমণী রত্নকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে রাসমঞ্চ ছেড়ে চলে গেলেন–প্রশমায় প্রসাদায় তত্রৈবান্তরধীয়ত।
ভাগবত-পুরাণের মহাকবি এই ভাগ্যবতী রমণীটির নাম করেননি, কিন্তু তাকে একাকিনী প্রসন্ন করার মাধুর্য এবং অন্যান্য রমণীদের গর্বনাশ করার মধ্যে পোট্টিস নামে সেই অখ্যাত লোক-কবির অন্তর-ছায়া ভেসে এসেছে। অতএব এই শত গোপরমণীদেরই বা আমরা অস্বীকার করি কী করে, কী করেই বা অস্বীকার করি শ্যাম-মনোমোহিনী রাই কিশোরীকে। মহাভারতের যখন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের পালা চলছে, তখন নাকি তিনি আপন লজ্জা বাঁচাতে কৃষ্ণকে স্মরণ করে অনেক কেঁদেকেটে ডেকেছিলেন–কৃষ্ণ গোপীজনপ্রিয়। পণ্ডিতেরা হই-হই করে জবাব দিয়ে বলেছেন–এ শ্লোক প্রক্ষিপ্ত। এমনকি সম্পূর্ণ বস্ত্রহরণ-খণ্ডে দূরস্থিত কৃষ্ণকে ভগবান বলে ডাক ছাড়াটাই নাকি দ্রৌপদীর অন্যায় হয়ে গেছে। এমন অলৌকিক আবেশ তার ওপরে চাপানো দ্রৌপদীর মোটেই উচিত হয়নি বলে–ওই সমস্ত ব্যাপারটাই নাকি প্রক্ষিপ্ত।
প্রক্ষিপ্তবাদীদের সঙ্গে আবারও ঝগড়ায় নামতে চাই না। কারণ ওঁদের যুক্তি-তর্ক সবটাই মূলোচ্ছেদী পাণ্ডিত্য। বিপদে পড়লে স্বর্গস্থিত বাপকেও তারা যখন বাপ বলে ডাকেন, তখন আমাদের বলা উচিত–ওরকম বাপের অস্তিত্ব মানি না। সে যাইহোক–বিপন্না দ্রৌপদীর কাছে কৃষ্ণের গোপীজনপ্রিয়তা সত্য হলেও মহাভারতের শুদ্ধতারক্ষী পণ্ডিতবাহিনীর কানে তা পৌঁছয়নি, কিন্তু কোথাকার কোন অনামা কবি পোট্টিস তার একটি মাত্র শ্লোকে কৃষ্ণের সেই গোপীজনপ্রিয়তা এঁকে রেখে দিয়েছেন এবং শুদ্ধিবাদীদের থেকে গ্রাম্য পোট্টিসকে আমরা বেশি মূল্য দিই, কারণ সাতবাহন হাল সেই মূল্য তাকে দিয়েছেন।
মনে রাখতে হবে, হরিবংশ কিংবা পুরাণগুলি যদি উত্তর ভারতের আর্য প্রকৃতির মানুষের লেখা হয়, তবে তার সাময়িক কালে দক্ষিণ ভারতেও কিন্তু কৃষ্ণ এবং তার আহিরিণী সঙ্গিনীদের নিয়ে কাব্য লেখা হয়েছে। ফ্রিমে হার্ডি নামে এক আধুনিক গবেষক অনেক পরিশ্রমসাধ্য গবেষণা করে দেখিয়েছেন প্রাচীন চঞ্চম সাহিত্যে কীভাবে গোপীজনপ্রিয় কৃষ্ণ একাত্মক হয়ে গেছেন মায়োন বা মায়াবন নামে এক যুবকের সঙ্গে। এ ছাড়া আছে সুপ্রাচীন তামিল গ্রন্থ শিলঞ্চড়িকার। খ্রিস্টীয় দু-এক শতাব্দীর মধ্যে লিখিত এই গ্রন্থে দেখা যাচ্ছে গোপ আর গোপীরাই এক যুবক-যুবতীকে পূজা উপাসনা করে। এই যুবক-যুবতীর একজন অবশ্যই মায়োন কৃষ্ণ আর যুবতীটি হলেন নপ্পিনাই, যিনি অবশ্যই রাধা। তামিল কবি–একটি রাসনৃত্যের উল্লেখ করেছেন, যার অনুকরণে নৃত্য করতেন মাদুরাই-এর রমণীরা। এই রমণীদের নাচের মডেল হলেন বালিয়োন (বলরাম), মায়োন (কৃষ্ণ) এবং নপ্পিনাই অর্থাৎ রাধা।