এটা ভাবতেই হবে যে, সেই প্রাচীনকালে তাদের মতো করেই এক পৃথক ইতিহাস-বোধ পৌরাণিকদেরও ছিল। গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে নিজেদের মতো করেই একটা নিয়ম-বিধি তারাও মেনে চলতেন। যে ঘটনা এক পুরাণে বিবৃত হয়েছে সবিস্তারে, সে ঘটনার উল্লেখ অন্য পুরাণেও করা হয়েছে সংক্ষিপ্তভাবে। বিখ্যাত ঘটনার পুনরাবৃত্তি করা পুরাণকারের অভ্যাস, কিন্তু যে সব ঘটনা পৃথক এবং সবিস্তারে বলা প্রয়োজন, তার জন্য প্রথমেই প্রতিজ্ঞাবাক্য উচ্চারণ করে কথা আরম্ভ করতেন পৌরাণিকরা। আপনারা হরিবংশের প্রসঙ্গেই দেখুন কুলপতি শৌনক পুরাণজ্ঞ কথক ঠাকুর, সৌতির উদ্দেশে বলছেন–মুনিবর! আপনি আমাদের মহাভারতের অমৃত-কথা শুনিয়েছেন। আপনি সেখানে সবিস্তারে জানিয়েছেন–কী করে কুরুবংশের প্রতিষ্ঠা হল। কিন্তু আপনি আমাদের বৃষ্ণি-অন্ধকদের কথা একটুও শোনাননি। এখন অন্তত সেই বৃষ্ণি-অন্ধকদের কথা আমাদের শোনান–ন তু বৃষ্ণন্ধকানাঞ্চ তদ্ভবা বক্তৃহসি।
এই পৃথক জিজ্ঞাসাটাই এখানে বড় জরুরী। সারা মহাভারত জুড়ে কৌরব-পাণ্ডবদের ক্রমিক প্রতিষ্ঠার খবর আমরা পেয়েছি। কিন্তু প্রতিষ্ঠার অন্তরালে যে সূত্রধার মহাভারতের সমস্ত ঘটনার নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছেন সেই কৃষ্ণের কথা আমরা যাই শুনে থাকি, তার কোনও পরম্পরা নেই। তাঁর বাল্যকাল নেই, কৈশোরগন্ধী বয়সের কথা নেই, নেই যৌবনের প্রথম অভিসন্ধির কথা। এমনকি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর ক্রমিক প্রতিষ্ঠার প্রথম ইতিহাসটুকুও একেবারেই নেই। কিন্তু সেটা তো শুনতে হবে। সেই শোনার তাগিদে তার কৈশোর-যৌবনের প্রথম কীর্তিকলাপের কাহিনী আমরা খানিকটা শুনিয়েছি, কিন্তু তারপরেই খানিকটা স্তব্ধ হয়ে ভণিতা আরম্ভ করেছি–কেননা, ইন্দ্ৰযজ্ঞ বন্ধ হয়ে যাবার পর আমাদের অপ্রতিম নায়ক এখন সামান্য অবসর পেয়েছেন এবং সেই অবসরে তার মনে পড়ছে বৃন্দাবনের কতগুলি রমণীর কথা, যাঁরা গোপিনী, আহিরিণী বলে পরিচিত।
গোপীদের কথায় মহামতি বঙ্কিমচন্দ্রের কেমন প্রতিক্রিয়া হতে পারে তার প্রমাণ কৃষ্ণচরিত্রের পাতায় পাতায় আছে। তিনি বিবাহিতা স্ত্রীদেরই স্বীকার করেন না, তো তথাকথিতভাবে নিন্দিত গোপীপ্রেম! তবে বঙ্কিম যে কৃষ্ণজীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অধ্যায়টি বাদ দিয়ে ভারতবর্ষের দর্শন-মনন এবং রসশাস্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এবং তা যে ঠিক হয়নি তার জন্য বেশি তর্ক করতে চাই না এখানে। তবে জানবেন তর্কের জন্য প্রস্তুত আছি। এই অন্যায় যে কতটা তার প্রমাণ হিসেবে আমরা আরেক মহামান্য জনের সামান্য বক্তৃতার অংশ তুলে দিই খানিকটা। তিনি সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ। ম্যাড্রাসের এক জনসভায় বঙ্কিমকে কটাক্ষ করে তিনি লিখেছেন
গোপীপ্রেম দ্বারাই সগুণ ও নিষ্ঠুণ ঈশ্বরের সম্বন্ধে বিরোধের একমাত্র মীমাংসা হইয়াছে। কৃষ্ণ অবতারের মুখ্য উদ্দেশ্য এই গোপীপ্রেম শিক্ষা দেওয়া এমনকি দর্শনশাস্ত্র-শিরোমণি গীতা পর্যন্ত সেই অপূর্ব প্রেমোন্মত্ততার সহিত তুলনায় দাঁড়াইতে পারে না। আমাদেরই স্বজাতি এমন অনেক অশুদ্ধচিত্ত নির্বোধ আছে যাহারা গোপীপ্রেমের নাম শুনিলেই উহা অতি অপবিত্র ব্যাপার ভাবিয়া ভয়ে দশ হাত পিছাইয়া যায়।… ভারতে এখন অনেকের মধ্যে একটা চেষ্টা দেখা যায় সেটা যেন ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়ার মতো। আমাদের মধ্যে অনেকের ধারণা—কৃষ্ণ গোপীদের সাহত প্রেম করিয়াছেন, এটা সাহেবরা পছন্দ করেন না। তবে আর কি, গোপীদের যমুনার জলে ভাসাইয়া দাও। সাহেবদের অনুমোদিত না হইলে কৃষ্ণ টেকেন কি করিয়া? কখনই টিকিতে পারেন না। …মহাভারতের দু-একটা হল ছাড়া–সেগুলিও বড় উল্লেখযোগ্য স্থল নহে–গোপীদের প্রসঙ্গ নাই। দ্রৌপদীর স্তবের মধ্যে এবং শিশুপালের বক্তৃতায় বৃন্দাবনের কথা ছে মাত্র। এগুলি সব প্রক্ষিপ্ত। সাহেবরা যা চায় না সব উড়াইয়া দিতে হইবে। গোপীদের কথা, এমনকি কৃষ্ণের কথা পর্যন্ত প্রক্ষিপ্ত!
আমরা বিবেকানন্দের হতাশা আন্দাজ করতে পারি। আমরা বুঝতে পারি–কৃষ্ণের এই জীবন দার্শনিকদের দার্শনিকতা পুষ্ট করে, সগুন-নির্গুণ ব্রহ্মের বিরোধ মীমাংসা করে। কিন্তু আমরা দার্শনিক নই, আমরা দর্শনের চেয়েও আপাতত ইতিহাসের প্রমাণে বিশ্বাসী। কৃষ্ণজীবনের সমস্ত ঘটনাই যেহেতু সাহিত্যের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে, তাই আগে আমাদের বুঝে নিতে হবে যে, খ্রিস্টীয় শতকগুলির আরম্ভে এবং আগে-পরে কৃষ্ণের সঙ্গে গোপরমণীদের কোনও সম্বন্ধ নথিবদ্ধ হয়েছে কিনা। যদি হয়ে থাকে তবে তা কৃষ্ণ-গোপীর যুগল-সম্বন্ধের ঐতিহাসিকতারও প্রমাণ হতে পারে–অথবা লোকপ্রিয়তারও প্রমাণ হতে পারে। ঐতিহাসিকতার প্রমাণ বলে মানলে আমাদের কোনও বিপদ থাকে না, আর যদি সেসব কথাকে লোকপ্রিয়তার প্রমাণ বলেই মানেন, তাহলে বলতে হবে–মানুষটিই যদি কাল্পনিক হন, গোপীরাও যদি সব কল্পলোকের নায়িকা হন, তবে এই সব কাহিনীর এত লোকপ্রিয়তা সম্ভব হয় কী করে? অতএব আমাদের মতে কৃষ্ণ-জীবনের এই অংশের লোকপ্রিয়তাই তার ঐতিহাসিকতারও প্রমাণ।
হরিবংশ এবং পুরাণগুলি তো কৃষ্ণজীবনের প্রথমাংশের ঐতিহাসিকতা প্রমাণ করবেই কিন্তু তার আগে আমরা সাতবাহনরাজ হালের কথা বলব। সাতবাহন হাল তার অনবদ্য প্রাকৃত কাব্য গাহাসত্তসঈর মধ্যে অন্তত চারটি লিরিক লিখেছেন যার মধ্যে কৃষ্ণের বাল্যকাল এবং যৌবনের তিনটি ঘটনার উল্লেখ আছে এবং এই শ্লোকগুলি কোনওভাবেই প্রক্ষিপ্তবাদের আওতায় পড়ে না। হালের সময় খ্রিস্টপূর্ব ২৩৫ শতক থেকে খ্রিস্টিয় ২২৫ শতকের মধ্যে বলে পণ্ডিতরা মনে করেন। সময়টা একেবারে নির্দিষ্ট না হলেও যথেষ্ট প্রাচীন। তার ওপরে কথা হল গাহাসত্তসঈর শ্লোকগুলি সবই হালের লেখা নয়, তার সংগৃহীত। হয়তো এই সংগৃহীত শ্লোক আরও প্রাচীনকালে লেখা। যাইহোক আসল কথায় আসি। একটি শ্লোকে দেখছি–স্নেহাতুরা জননী যশোমতী সামনে দাঁড়ানো ব্রজরমণীদের কথার জবাবে বলছেন–আমার দামোদর কৃষ্ণ এখনও দুগ্ধপোষ্য শিশু–অজ্জ বি বালো দামোদরেত্তি। কথাটা শুনে নাকি সামনে উপস্থিত ব্রজরমণীরা কৃষ্ণের দিকে একবার তেরচা করে চেয়ে নিজেরা মুখ লুকিয়ে হেসেছিল।