আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাই বঙ্কিমের নিজের সময়েই তার একদেশদর্শিতার জন্য প্রতিবাদ হয়েছিল। আপনারা ভাবতে পারেন কি, ব্রাহ্ম মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থাতেও জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন–দ্যাখো, বঙ্কিম যে রকম করে কৃষ্ণচরিত্র আলোচনা করছে, তার একটা প্রতিবাদ হওয়া আবশ্যক। দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করেছিলেন এইভাবে
বঙ্কিমচন্দ্র শেষাশেষি যতই গীতাভক্ত হউন না কেন তিনি অনেকদিন ধরিয়া পাকা পজিটিভিস্ট ছিলেন। পজিটিভ ফিলসফি যাহাই হউক না কেন, শুধু মানুষকে লইয়া একটি পজিটিভ রিলিজন দাঁড় করাইবার চেষ্টা করিলে চলিবে কেন? রিলিজন কি অমনি গড়িয়া তুলিলেই হয়, পজিটিভিস্ট চাহিল একজন গ্র্যান্ড ম্যান, মহাপুরুষ। বঙ্কিমবাবু ভাবিলেন, এই তো আমাদের হাতের কাছে একজন গ্র্যান্ড ম্যান রহিয়াছেন; যেমন বিষয়বুদ্ধি, তেমনি পরমার্থজ্ঞান, এইরকম চৌকস মানুষ দরকার। অতএব আমাদের দেশে পজিটিভিস্ট রিলিজন দাঁড় করাইতে হইলে শ্রীকৃষ্ণকে গ্র্যান্ড ম্যান করিলেই সর্বাঙ্গসুন্দর হইবে। তবে বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণকে আর মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণকে এক করিলে চলিবে না। ফলে দাঁড়াইল বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচরিত্র।
একবার ভেবে দেখুন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ নিরাকার ব্রহ্মে বিশ্বাসী ব্রাহ্ম ছিলেন। পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথও তাই। দেবেন্দ্রনাথ এবং দ্বিজেন্দ্রনাথের আত্মক্ষমতা, ব্যক্তিত্ব অথবা পাণ্ডিত্য কিছু কম ছিল না। অন্তত পণ্ডিতজনেরা তাই বলেন। কিন্তু এঁরা ব্রাহ্ম হওয়া সত্ত্বেও কৃষ্ণের পূর্বজীবনের প্রক্ষেপবাদিতাও স্বীকার করতে পারেননি, তাঁর বৃন্দাবনের জীবন এবং মহাভারতীয় জীবনের খণ্ডতাও মেনে নিতে পারেননি। এর কারণ কী? আমি নিজে একটা ধর্ম অবিশ্বাস করতেই পারি, আমি বৈষ্ণব না হতে পারি শাক্ত না হতে পারি, আমি নিরীশ্বরবাসী হতে পারি, আমি ব্রাহ্ম হতে পারি–কিন্তু কৃষ্ণ তো কোনও বৈষ্ণব, শাক্ত, বা ব্রাহ্ম নন। তিনি যে সমগ্র ভারতবর্ষের অন্তরাত্মার সঙ্গে জড়িত। তার বৃন্দাবনী সরসতা যে লীলার পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। হঠাৎ করে এখন যদি তাকে বৃন্দাবন থেকে উচ্ছেদ করে দিয়ে, তার বাল্য, কৈশোর যৌবন বিসর্জন দিয়ে এক ধাক্কায় তাকে যদি মহাভারতের রঙ্গমঞ্চে উপস্থিত করি, তাহলে কি সুবিচার হবে? না এতে তার সম্পূর্ণতা আসবে।
আমাদের তাই সেই শারদ রজনীটির কথা ভাবতেই হবে। সেই যেদিন সমস্ত গোপ–বৃদ্ধরা কৃষ্ণের আসল পরিচয় না পেয়ে দুঃখ নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। আর কৃষ্ণ বৃন্দাবনের শান্ত প্রকৃতির মধ্যে, তাল-তমালের বনের মধ্যে, উতলা হাওয়ার মধ্যে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন–গগনবিহারী চন্দ্রমা যৌবন প্রাপ্ত হয়েছে। শারদ রাত্রির যুবক চাঁদ আর সুরম্য বনরাজি দেখে যুবক কৃষ্ণের হৃদয় আকুল হয়ে উঠল–
কৃষ্ণস্তু যৌবনং দৃষা নিশি চন্দ্রমসো বনম্।
শারদীঞ্চ নিশাং রম্যাং মনশ্চক্রে রতিং প্রতি।
১২০. যাঁরা প্রাচীন বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন
১২০.
যাঁরা প্রাচীন বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন এবং করেছেন, তাদের ওপর আমাদের বিপুল শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও জানাই যে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের কিছু অভিযোগ আছে। বিশেষত যাঁরা কৃষ্ণচরিত্রের ওপর গবেষণা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে। আমরা ভেবে অবাক হই–দ্বারকাবাসী তথা মহাভারতীয় কৃষ্ণের ক্ষমতা, আড়ম্বর আর মর্যাদা দেখে গবেষকরা প্রমাণ করে দিলেন যে, এই কৃষ্ণের সঙ্গে রাখাল ব্রজবালক কৃষ্ণকে কখনই মেলানো যায় না। তার মধ্যে আবার যদি ব্ৰজযুবতীদের উপস্থাপনা ঘটে, তবে তো সেই রমণী-মোহন মধুর কৃষ্ণের সঙ্গে মহাভারতীয় ঐশ্বর্যশালী কৃষ্ণের কোনও মিলই খুঁজে পাওয়া যাবে না। অন্তত গবেষকের গো-ধরা আত্মপ্রমোদিনী গবেষণায় এই মিল প্রায় অসম্ভব। আমাদের অবাক লাগে–আমরা এমন অনেক তুখোড় রাজনীতিবিদ, মহান শিক্ষাবিদ, এমনকি অনেক সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীকেও চিনি, যাঁরা পূর্ব জীবনে রমণীকুলের পরম আকাঙ্ক্ষিত ছিলেন। একাধিক রমণীর সঙ্গে তাদের অপার যৌবন-বিলাস তথা যৌবন-স্বার্থকতার ঘটনাও আমাদের শ্রুতিগোচর হয়েছে। তাহলে কি বলতে হবে–সেই রমণীসঙ্গকার যুবক ব্যক্তিটি পরবর্তীকালের ধুরন্ধর, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ কিংবা সন্ন্যাসীটি থেকে আলাদা কোনও ব্যক্তি বিভিন্ন বয়সে তাদের সত্তা পৃথক হতে পারে কিন্তু তাতে তাদের ব্যক্তিত্বের অভিধান পালটাবে কি?
এই কথাটা মনে রাখা দরকার যে কৃষ্ণ-জীবনের বেশিরভাগ ঘটনারই উপাদান হল প্রাচীন সাহিত্য। শিলালিপিতে খোদাই করা জাদুকরী ভাষা নেই, দ্বারকার টাকশাল থেকে প্রকাশিত কৃষ্ণের নামাঙ্কিত কোনও মুদ্রা নেই, নেই তাম্রশাসন বা দানপত্র। কৃষ্ণের জীবন-প্রমাণ যা আছে, তা সবই সাহিত্যে। সেখানে এক সাহিত্যে তাঁর উত্তর জীবনের ঘটনাবলীর প্রমাণ পেয়ে তাকে ঐতিহাসিকতায় মণ্ডিত করব, আর পূর্বজীবনের ঘটনাবলী যেখানে আছে, সেই সাহিত্য মহাভারতের সামান্য পরবর্তী বলে তাকে উপন্যাস বলব–গবেষকদের এমন দৃপ্ত ঘোষণা না থাকাই ভাল ছিল।
নিজেদের যাঁরা ঐতিহাসিক বলে জাহির করেন, তারা একবার ভেবে দেখলেন না যে, প্রাচীন পৌরাণিকদেরও ঐতিহাসিক ভাবা যায় কিনা। হতে পারে, রাজবংশের ইতিহাস বলতে গিয়ে তারা কিছু কাব্য করে ফেলেছেন। কিছু অতিশয়োক্তি বা অলৌকিকতাও তাঁদের রচনায় থাকতে পারে। কিন্তু এটাও তো ভাবতে হবে যে, তারা পুরাণ রচনার সময় প্রতিজ্ঞা করছেন যে–আমরা বংশ, প্রতিবংশ এবং মন্বন্তরের ইতিহাস বলব। হেরোডাটাস বা এইরকম মানের ঐতিহাসিক যাঁরা, তাদের মুখের লোকশ্রুত বিবরণও আমাদের কাছে ইতিহাস, আর পৌরাণিকরা একটু গপ্পো বলতে ভালবাসেন বলে তাদের উপাখ্যানের অন্তরে কোনও ইতিহাস নেই, একথা বলা নিতান্তই আহম্মকি।