মহাভারত আর পুরাণের তথাকথিত প্রক্ষেপ-পঙ্ক থেকে কৃষ্ণকে উদ্ধার করে কৃষ্ণের কপালে যতই আদর্শ লোক-শিক্ষকতার তিলক টেনে দিন বঙ্কিমচন্দ্র, তাতে কৃষ্ণের থেকেও পুরাণ-ইতিহাসের লেখকদের প্রতি বড় অবিচার হয়ে গেছে। মহামতি বঙ্কিম কেন এই অদ্ভুত কর্মে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন আমরা জানি। পণ্ডিতজনে বলেন–১৮৯২ সালে কৃষ্ণচরিত্র প্রকাশিত হবার আগে রেভারেণ্ড হেস্টি নামে এক ভদ্রলোক কৃষ্ণের বৃন্দাবন-লীলা সম্বন্ধে নানা অকথা-কুকথা বলেছিলেন। কৃষ্ণ পূর্বজীবনে রাধা-চন্দ্রাবলীর সঙ্গে তার লাম্পট্য বিবৃত করে সাহেব-যাজক সাধারণ মানুষের মধ্যে কৃষ্ণ সম্বন্ধে বিরূপতা প্রচার করতে থাকেন। শোনা যায়, এই সাহেবের কুপ্রচার অপ্রমাণ করে কৃষ্ণকে এক মহান আদর্শ পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই বঙ্কিম কৃষ্ণচরিত্রের উপস্থাপনা করেন। যাজক-সাহেব এতে বিধ্বস্ত হলেন কিনা জানি না, কিন্তু বঙ্কিম এতে বড়ই তৃপ্ত বোধ করেছেন নিশ্চয়ই।
সাহেবের বিরুদ্ধতা করে বঙ্কিম যা লিখলেন, তাতে তার দেশপ্রেম, স্বধর্মনিষ্ঠা বা বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা না করে কোনও উপায় নেই। কিন্তু একপেশে বিচার করতে গিয়ে তিনি যে একটু সাহেবদের তৈরি করা কলেই আটকে গেলেন, সেকথা বোঝাই কী করে। মনে রাখা দরকার, বঙ্কিম যখন কৃষ্ণ চরিত্র লিখছেন, তখন সাহেবরা এদেশের প্রাচ্যবিদ্যা নিয়ে যথেষ্ট মাথা ঘামাতে শুরু করেছেন। কিন্তু এই শুরুর মধ্যে এশীয়–তথা ভারতবর্ষীয় সমাজ-সংস্কৃতির প্রতি তাদের শ্রদ্ধা যতখানি ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল ত্রুটি খুঁজে বার করার চেষ্টা। যে বিশাল শ্রবণ-মনন এবং চর্চার ওপর ভারতবর্ষের ধর্ম, দর্শন এবং সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত, সেদিকে না গিয়ে সাহেবরা নিজস্ব পদ্ধতিতে আমাদের গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করলেন। তাতে সুফলও অনেক ফলেছে বটে, কিন্তু সেই তাদের নিজস্ব বিচার-পদ্ধতি আমাদের ভাগ্যে কিছু বিড়ম্বনাও এনে দিয়েছে।
লক্ষণীয় বিষয় হল, বঙ্কিম রেভারেন্ড হেস্টির প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়ে যেভাবে কৃষ্ণচরিত্র প্রতিষ্ঠা করলেন, তাতে আদর্শের সুপ্রতিষ্ঠা হল বটে, কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠার জন্য যে বিচার-পদ্ধতি বেছে নিলেন, তা নিতান্তই বিদেশী। আপাতভাবে একটা ইংরেজ-বিরোধী মনোভাব সামনে রেখেও বঙ্কিম দেখাতে চাইলেন যে–দ্যাখ! যদি তোমার পদ্ধতিতেও বিচার করা যায়, তবু কৃষ্ণকে ধর্ম ও লোকশিক্ষার আদর্শ পুরুষ হিসেবে প্রমাণ করা যায়। বঙ্কিম সত্যিই তা করে দেখালেন এবং তার ফলেই অর্ধেক কৃষ্ণচরিত্রকে তিনি প্রক্ষিপ্তবাদের পাঁকে ডুবিয়ে দিলেন। বঙ্কিমের প্রতি আমাদের অসামান্য শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও আমাদের মনে হয়, এ কাজ বঙ্কিম না করে সাহেবসুবোরা করলেই ভাল করতেন।
কেন একথা বলছি শুনুন। আমরা ধরেই নিলাম মহাভারত পুরাণে পরবর্তী কবি-মহাকবিদের হস্তাবলেপ ঘটেছে। কিন্তু কোনও ক্রমেই সেগুলিকে মূল্যহীন বলতে পারি না অথবা ট্র্যাডিশন-বিরোধীও বলতে পারি না। তাছাড়া এই সমস্ত প্রক্ষেপের পৌর্বাপর্য-বিনিশ্চয় ক্ষমতা কার আছে? রামায়ণের বালকাণ্ড এবং উত্তরকাণ্ডকে পণ্ডিতজনেরা প্রক্ষিপ্ত বলে মনে করেন, কিন্তু সেই প্রক্ষিপ্ত অংশ অবলম্বন করেই দ্বিতীয়-তৃতীয় খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই নাট্যকার ভাস তাঁর অভিষেক এবং প্রতিমা নাটক লিখেছেন। রামায়ণের তথাকথিত প্রক্ষিপ্ত অংশ অবলম্বন করেই কালিদাস তার রঘুবংশে মহাকাব্যের প্রতিভা বিকিরণ করেছেন এবং এই প্রক্ষিপ্ত অংশের উপাদানেই ভবভূতি তাঁর উত্তররামচরিত সৃষ্টি করেছেন।
মহাশয়! ভাস-কালিদাস-ভবভূতিরা গাধা-গোরু ছিলেন না, অন্তত সমালোচক সাহেব-সুবো এবং আধুনিক কিছু অনুপাসিত-গুরু ভারতবর্ষীয় গবেষকের চাইতে যে বেশি পণ্ডিত ছিলেন, সে কথা না বললেও চলে। তো এরা খ্রিস্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতাব্দীতে রামায়ণের প্রক্ষিপ্ত অংশের এত মূল্য দিয়ে থাকেন, তাহলে এই প্রক্ষেপগুলির প্রাচীনতা কত। কাজেই বঙ্কিম যতই প্রক্ষেপ-প্রক্ষেপ বলে গলা ফাটান, তাতে শাসক-সাহেবদের তৃপ্তি ঘটতে পারে, স্বদেশী পণ্ডিতজনের তাতে কিছু যায়-আসে না।
আরও একটা কথা বলি–কৃষ্ণ-চরিত্র লিখতে গিয়ে শ্রদ্ধেয় বঙ্কিমচন্দ্র একবারও ভারতবর্ষীয় দার্শনিক সম্প্রদায়ের পরম্পরার কথা চিন্তা করলেন না। অবতার-পুরুষদের নিয়ে তারাও তো মাথা কম ঘামাননি। রামানুজ, নিম্বার্ক, বিষ্ণুস্বামী, মধ্বাচার্য, বল্লভাচার্য এবং পরিশেষে চৈতন্যদেব, রূপগোস্বামী, সনাতন গোস্বামী, জীব গোস্বামী–এইসব বিশালবুদ্ধি পুরুষের বিচারও কি একেবারেই উপেক্ষণীয়? কৃষ্ণের পূর্বজীবনে যে বৃন্দাবনী সরসতা আছে, রাধারসমহিমা আছে, সেগুলিকে তো তারা লাম্পট্য বলেননি। তারা তো দর্শনের প্রতিষ্ঠায় কৃষ্ণের সরসতা প্রমাণ করেছেন। তাই সেগুলিকে একেবারে বিনা বিচারে উড়িয়ে দিই কী করে?
বেশ বোঝা যায়, বঙ্কিম স্বেচ্ছায় সুপরিকল্পিতভাবে নিজ সিদ্ধান্ত সপ্রমাণ করার জন্যই কৃষ্ণচরিত্রের একাংশমাত্র উপস্থাপন করেছিলেন, কারণ তাতেই তার স্বমত প্রতিষ্ঠার সুবিধে হয়। অবশ্য কোনও গবেষক যদি স্বমত প্রতিষ্ঠার জন্য এমত একদশী নাও হন তবে তবুও তাতে খণ্ডাংশের সত্য-স্বীকৃতি থাকে, বঙ্কিমে তাও নেই।