আর কী বলব! গোপ-রমণীদের কথা ছেড়েই দিলাম, কৃষ্ণের বিয়ে করা বউদের আটটির মধ্যে সাতটিকেও তিনি মানেন না। এমনকি আমাদের মতে সত্যভামা–জাম্ববতীর মতো ঐতিহাসিক-রমণীকেও তিনি কৃষ্ণ-জীবনের বাইরে রেখেছেন। বেচারা কৃষ্ণ! বঙ্কিমের জবানীতে স্বামীগতপ্রাণা রুক্মিণী ভিন্ন তার আর অন্য গতি নেই, যেমন ভ্রমর ছাড়া শেষ গতিটি নেই গোবিন্দলালের। আমরা বলি–সত্যিই তো, কৃষ্ণের মতো আদর্শ অবতার-পুরুষের পক্ষে অনন্যা রুক্মিণী ছাড়া আর কি কোনও স্ত্রী থাকা উচিত? ঔচিত্যের প্রশ্নে ঠিকই আছেন বঙ্কিমচন্দ্র। কিন্তু মহাশয়! কৃষ্ণকান্তের উইল কীর্তনের সময় শুধু ভ্রমর আর গোবিন্দলালের আদর্শ প্রেমকাহিনীটুকু বর্ণনা করলেই তো পারতেন তিনি। শুধু শুধু এক কলঙ্কিনী বিধবা সুন্দরীকে কাহিনীর মধ্যে এনে আদর্শ কাহিনীর শুচিতা নষ্ট করা কেন!
বস্তুত জীবনের কাহিনী এমনটিই হয়, যেমনটি বঙ্কিম লিখেছেন। বিরাট ব্যক্তিত্ব আর আদর্শ পুরুষ বলেই কোনও মহান ব্যক্তির জীবনে কোনও পূর্ব-প্রণয় থাকবে না, এমনটি না ভাবাই ভাল। পূর্ব-প্রণয় যদি বা নাও থাকে, সেকালের আদর্শ পুরুষ প্রত্যেকেই রামচন্দ্রের মতো এক পত্নীব্রত হবেন, এমনটিই বঙ্কিম ভাবলেন কী করে। যেখানে যুধিষ্ঠির-নকুল-সহদেবেরও একাধিক পত্নী ছিলেন বলে শুনি, সেখানে কৃষ্ণের মতো ঐতিহাসিক ব্যক্তির একাধিক পত্নী থাকবে না, এটাই বা কেমন কথা? আর সেকালে বহু বিবাহ আভিজাত্যের অঙ্গও তো ছিল বটে।
বঙ্কিমের যুক্তি কী রকম? না, রুক্মিণী ভিন্ন আর কোনও কৃষ্ণমহিষীর পুত্র পৌত্র কাহাকেও কোনও কর্মক্ষেত্রে দেখা যায় না। রুক্মিণী বংশই রাজা হইল। আর কাহারও বংশের কেহ কোথাও রহিল না। এই সকল কারণে আমার খুব সন্দেহ যে, কৃষ্ণের একাধিক মহিষী ছিল না।
এ যে কী রকম যুক্তি, তার অন্ত খুঁজে পাই না। আমরা যদি বলি–সুভদ্রার বংশই হস্তিনাপুরে রাজা হল। আর কোনও বংশের কেউ কোথাও রইল না। অতএব সুভদ্রাই অর্জুনের একমাত্র স্ত্রী ছিলেন, দ্রৌপদী মিথ্যে, চিত্রাঙ্গদা-উলুপীও মিথ্যে। তবে এটা কি কোনও যুক্তি হল? যাঁরা এমন কট্টরভাবে একমেবাদ্বিতীয়ের মত আঁকড়ে থাকেন, তাদের বিরুদ্ধে বৈষ্ণব রামানুজাচার্যের গুরু যামুনাচার্য ভারি সুন্দর একটা যুক্তি দিয়েছেন। স্পষ্টতই তিনি অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত ব্রহ্মের প্রস্তাব নিরসন করছিলেন। তিনি বলেছেন–এই চোল-দেশের রাজা পৃথিবীর অদ্বিতীয় সম্রাট, তাহলে বুঝতে হবে তার মতো খ্যাতকীর্তি রাজা আর দ্বিতীয় নেই জগতে। কিন্তু এ কথার মানে তো এই নয় যে, তাঁর পুত্র-পরিবার, ভৃত্য-নফর কেউ ছিল না–ন তু তৎ পুত্র-তভৃত্য-কলত্রাদি-নিবারণম্।
আমাদের যুক্তিও ঠিক একই রকম। কৃষ্ণের জীবনে রুক্মিণী তাঁর আত্মগুণে অদ্বিতীয়া পত্নী হিসেবেই চিহ্নিত হতে পারেন। কিন্তু তাই বলে সত্যভামা, জাম্ববতী–এঁরা সব মিথ্যা হয়ে যাবেন, তা কী করে বলি। এঁদের ছেলে-পিলেরাও তো কম কাণ্ড করেননি, বিশেষত জাম্ববতী পুত্র শাম্ব। আসলে বঙ্কিমের যুক্তি বড়ই একপেশে। কৃষ্ণকে আদর্শস্থানে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি তার জীবনের অতি পরিচিত অংশগুলি বাদ দিয়ে দিয়েছেন। বাদ দিয়েছেন এই ভয়ে যে, যদি তথাকথিত ন্যায়-নীতি-ভ্রষ্টতার অপরাধে তার আদর্শ অবতার-পুরুষটি কলঙ্কিত হন।
বঙ্কিমের দুর্ভাবনাটুকু বোঝা যায়। তিনি লিখেছেন–মনুষ্য কতটা নিজরক্ষা ও বৃত্তি সকলের বশীভূত হইয়া স্বতঃই কর্মে প্রবৃত্ত হয়। কিন্তু যে কর্মের দ্বারা সকল বৃত্তির সর্বাঙ্গীণ স্ফুর্তি ও পরিণতি, সামঞ্জস্য ও চরিতার্থতা ঘটে তাহা দুরূহ। যাহা দুরূহ, তাহার শিক্ষা কেবল উপদেশে হয় না–আদর্শ চাই। সম্পূর্ণ ধর্মের সম্পূর্ণ আদর্শ ঈশ্বর ভিন্ন আর কেহ নাই।…
অতএব যদি ঈশ্বর স্বয়ং সান্ত ও শরীরী হইয়া লোকালয়ে দর্শন দেন, তবে সেই আদর্শের আলোচনায় যথার্থ ধর্মের উন্নতি হইতে পারে। এই জন্যই ঈশ্বরাবরের প্রয়োজন। মনুষ্য কর্ম জানে না; কর্ম কিরূপে করিলে ধর্মে পরিণত হয় তাহা জানে না; ঈশ্বর স্বয়ং অবতার হইলে সে শিক্ষা হইবার বেশি সম্ভাবনা, এমত স্থলে ঈশ্বর জীবের প্রতি করুণা করিয়া শরীর ধারণ করিবেন, ইহার অসম্ভাবনা কি?
আমরা জানি–লোকশিক্ষার জন্য, শিষ্টের পালনের জন্য এবং দুষ্টের দমনের জন্য অবতার-পুরুষ কৃষ্ণের যথেষ্ট করুণা আছে। কিন্তু অনেক করুণা থাকা সত্ত্বেও তার নিজের জীবন-ব্যবহার অন্যের পক্ষে খুব আচরণীয় কর্তব্য বলে নির্দিষ্ট হয়নি। অন্যান্য পুরাণ কাহিনীগুলির মধ্যে কৃষ্ণের পূর্ব-জীবন যেভাবে অঙ্কিত হয়েছে, তার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, শুধু মহাভারতের মধ্যেই দ্রোণ-কর্ণ ইত্যাদি মহাবীরের হত্যাকাণ্ড নিয়ে কৃষ্ণ চরিত্র যেভাবে কলঙ্কিত হয়েছে, তাতে তিনি সম্পূর্ণ ধর্মের সম্পূর্ণ আদর্শ হয়ে উঠেছেন কিনা, লোকে তাতে সন্দেহ করবে। বিশেষ সেই সব কূট আচরণের দ্বারা কর্ম ধর্মে পরিণত হবে কিনা, তা নিয়েও চিরন্তন প্রশ্ন আছে। বঙ্কিমের মতে কৃষ্ণ যতই মহাভারতের বিসমার্ক হন, বিসমার্কের রীতি-নীতি কি লোকশিক্ষার পক্ষে খুব উপযুক্ত।
আমরা তো বলি–বঙ্কিম যেমনটি চান, তাতে মহান রামচন্দ্রই একমাত্র ঈশ্বরাবরের আদর্শ হতে পারেন। দু-চারটে রাবণ-কুম্ভকর্ণ বধ করে অথবা কংস-শিশুপাল বধ করে অবতার পুরুষ যে ভূভার হরণ করেন, অবতার–গ্রহণের এই মুখ্য উদ্দেশ্যও মহামতি বঙ্কিমের মতে অতি অশ্রদ্ধেয় কথা। অবতারের কাজই নাকি শুধু আদর্শ স্থাপন। আমরা বলি–সেদিক দিয়ে রামচন্দ্রই হলেন সেই নরচন্দ্রমা, যিনি কথায় এবং কাজে সম্পূর্ণ ধর্মের সম্পূর্ণ আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। আর কৃষ্ণকে যদি এই ব্যাপারে বড় মানুষ মানতে হয় তবে তার জীবন থেকে খানিকটা খানিকটা খামচা খামচা তুলে এনে তবেই তাকে লোকশিক্ষার আদর্শ শিক্ষক হিসেবে মেনে নিতে হবে। নইলে তার সম্পূর্ণ জীবন ধরে প্রতিটি অভিব্যক্তির স্বরূপ বিচার করলে বঙ্কিমের বড়ই বিপদ হবে এবং এই বিপদ হবে বুঝেই তিনি পুরাণগুলির মধ্যে প্রক্ষেপ আর অধিক্ষেপের বন্যা বইয়ে দিলেন।