বলরামের মা বসুদেব-পত্নী রোহিণী গর্ভবতী অবস্থাতেই ব্রজে এসেছিলেন, আর বসুদেবের আরেক পুত্র রাতের অন্ধকারে চুপিসাড়ে ন্যস্ত হলেন নন্দ-রাজার ঘরে! আপনাদের কি মনে হয়–সহজ সরল ব্রজবাসীদের মধ্যে এই ঘটনা নিয়ে কোনও কৌতূহল ছিল না, কিংবা কোনও কথাবার্তাই হত না কখনও? নিশ্চয়ই হত এবং ব্রজবাসীদের চোখে এই দুটি ছেলের আলাদা মান–মর্যাদাও ছিল। সেই কারণেই গোবর্ধন পাহাড়ে আশ্রয় পাবার পর, ইন্দ্ৰযজ্ঞ স্তব্ধ হয়ে যাবার পর সহজ সরল ব্রজবাসীরা কৃষ্ণকে সহজভাবেই বলতে পেরেছিল–আজ তোমাকে তোমার পরিচয় বলতেই হবে। বলতেই হবে–কেমন করে বসুদেব তোমার পিতা হলেন–কিমর্থঞ্চ বসুদেবো পিতা তব?
.
১১৯.
কৃষ্ণের কথা শুনে ব্রজ-বৃদ্ধরা যখন বিনা বাক্যে ঘরে ফিরে গেলেন, তখনই বোঝা গেল কৃষ্ণের পরিচয় তারা অল্প-বিস্তর বুঝেই গেছেন। হরিবংশ ঠাকুর জানিয়েছেন–সেই দিনটা ছিল শরৎ পূর্ণিমার রাত্রি। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে প্রেমন-নয়নের দীছায়াময় পল্লবের মত। শরতের চাঁদ তার শীতল করাঙ্গুলি দিয়ে প্রাচী দিগবন্ধুর মুখখানি একবার স্পর্শ করতেই সে মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। সমস্ত পূর্বাকাশে ছড়িয়ে পড়ল জ্যোৎস্নার লালিমা। মানুষ কৃষ্ণের মনে হল–এমন শারদ রজনীতে যদি সেই সুন্দরী গোপরমণীরা কাছে থাকতেন। কৃষ্ণের বড় ইচ্ছে হল সেই অতি পরিচিতা সরলা রমণীদের সুখ-সঙ্গ লাভ করার। ইচ্ছে হল মিলনের–শারদীঞ্চ নিশাং রম্যাং মনশ্চক্রে রতিং প্রতি।
সহৃদয় পাঠক আমার! আমরা কৃষ্ণের-জীবনের এক চরম লগ্নে উপস্থিত হয়েছি কোনও ভণিতা ছাড়াই। বৃন্দাবনে সমস্ত গোপকুলের মধ্যেও কৃষ্ণের সর্বাতিশায়ী স্বাতন্ত্র্য, অনন্য-সাধারণ বুদ্ধি এবং ব্যক্তিত্বের প্রতিষ্ঠা করার পথে চলতে চলতে হরিবংশ-ঠাকুর হঠাৎ যে কেন কৃষ্ণকে এই শারদ রজনীর জ্যোৎস্না মাখিয়ে দিলেন, তাতে আমরা যথেষ্ট বিব্রত বোধ করছি। শুধু হরিবংশ কেন, কৃষ্ণ-সম্বন্ধী সমস্ত পুরাণ, বিশেষত ভাগবত পুরাণ তার অমৃতস্রবিনী ভাষায় কৃষ্ণকে অসুর-মারণ আর ব্যক্তিত্বময়তার কঠিন জগৎ থেকে তুলে এনে বৃন্দাবনের ফুল্ল-মল্লী-মালতী-যূথীর বনে প্রবেশ করালেন। আমরাও তাই বিনা ভণিতায়, বিনা গৌর-চন্দ্রিকায় কৃষ্ণের মনের ইচ্ছাটুকু আগেই ব্যক্ত করে ফেলেছি। কার্য-কারণ সম্বন্ধের কোনও বিচার না করে কৃষ্ণের মনঃস্থিত কতগুলি রমণীর কথা বলে ফেলেছি। দুঃখের বিষয়–এই রমণীদের সঙ্গে একবার পরিচয় করিয়ে দেবারও সুযোগ হয়নি আমাদের। অথচ হরিবংশ-ঠাকুরের কথার ফাঁদে পড়ে আমরা কৃষ্ণের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি।
আমাদের বিপদ আছে আরও। আধুনিক সমালোচক পণ্ডিতেরা আছেন। তাদের কাছে কৃষ্ণ আবার অনন্ত-রূপে দেখা দেন। মহাভারতের প্রবল রাজনীতি-ধুরন্ধর কৃষ্ণের সঙ্গে তারা বৃন্দাবনের গোপ–বেশী বেণুকর কৃষ্ণকে মেলাতে পারেন না। তাদের মতে দ্বারকার কৃষ্ণ এক, মথুরার কংসধ্বংসী কৃষ্ণ আরেক আর বৃন্দাবনের কৃষ্ণ আরও এক অন্য ব্যক্তি। এক পণ্ডিত-সুধী সরসে আমাকে বলেছিলেন–ওঁরা যে সকালের কৃষ্ণ আর বিকালের কৃষ্ণ বলে কিছু বলেননি, তাই বড় রক্ষে।
এঁদের সবার মাথার ওপরে চড়ে বসে আছেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র। তিনি অনবদ্য কূটযুক্তিতে এমন একখানি কৃষ্ণ-চরিত্র লিখে বসে আছেন, যা পড়লে মনে হবে–একেবারে অকাট্য যুক্তি। বেশির ভাগ পুরাণের কথাই সব গুল-গাপ্পায় ভরা। পুরাণগুলির মধ্যে এই অংশ প্রক্ষিপ্ত, ওই অংশ অসার, ওই পুরাণ আগে লেখা, অমুক পুরাণ পরে লেখা–এত সব বিদ্যাবত্তার প্রদর্শনী করতে গিয়ে মহামতি বঙ্কিম কৃষ্ণ-জীবনের অর্ধেকটাই বাতিল করে দিয়েছেন। তাঁর কৃষ্ণ চরিত্র পড়লে মনে হবে কৃষ্ণ লোকটার কোনও বাল্যকালও ছিল না, আর যৌবন? আদর্শ পুরুষের কোনও যৌবন থাকতে নেই যেন।
আবার মুশকিল হল–আমি যেখানেই এসব তত্ত্ব-কথা বলতে যাই, সেখানে জায়গা থাকে। কম, আর সে জায়গাটা মনোমত গবেষণা করার উপযুক্ত আধার বলেও চিহ্নিত নয়। নইলে মহামান্য বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিপক্ষতার গৌরবটুকু অন্তত লাভ করতে বাসনা হয় বইকি। আসলে বঙ্কিমচন্দ্রের মনে কৃষ্ণ এক আদর্শ অবতার পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছেন। সে আদর্শ এমনই যে, তার যদি যৌবন থেকেও থাকে, তাতে তার একটি মাত্র পত্নী ভিন্ন অন্য কোনও রমণীর কটাক্ষপাত পর্যন্ত থাকতে পারে না। অতবড় সাহিত্য-রসিক হওয়া সত্ত্বেও বঙ্কিম যে কেমন করে কৃষ্ণের মতো রসিক-চূড়ামণিকে রমণী-কটাক্ষ-বর্জিত এক পরুষ-পুরুষে পরিণত করতে পারলেন, তা ভাবলে আশ্চর্য হই।
এইরূপ শ্রুত আছি–কৃষ্ণকান্তের উইল লেখার পর কোনও এক পাঠক নাকি বঙ্কিমকে প্রশ্ন করেছিলেন–রোহিণীকে আপনি মেরে ফেললেন কেন? শুনি–বঙ্কিম নাকি এক কথায় উত্তর দিয়েছিলেন–ঘাট হইয়াছে। বস্তুত বঙ্কিম সাহিত্য-সৃষ্টির জন্য বিধবা রোহিণীর ওষ্ঠাধরে তাম্বুল রাগটিও এঁকে দেবেন, তার শরীরে আকর্ষণ-মন্ত্রও দেবেন, তাকে সৌন্দর্যও দেবেন এবং শেষে বিধবা বলেই আর কোনও অনাচার তিনি সহ্য করবেন না, তিনি বিধবাকে মেরে ফেলবেন। অপিচ মেরে ফেলে বলবেন–ঘাট হইয়াছে। আমরা মনে করি ওই একই আদর্শবাদ তার কৃষ্ণচরিত্রের মধ্যেও আছে, ফলে অভাগা গোপ-রমণীদের গলায় দড়ি-কলসী বেঁধে পৌরাণিক প্রক্ষেপ-পঙ্কে ডুবিয়ে মেরেছেন।