একই সঙ্গে জানাই পুরাণের তালিকায় আরও যেসব নাম আছে, তাতে শুধু ওই পশ্চিম–ভারতের কোস্টাল রিজিয়নই নয়, সমগ্র পশ্চিম ভারত তো বটেই, উপরন্তু দক্ষিণ দেশের কেরল পর্যন্ত এবং উত্তরে রাজপুতানা পর্যন্ত অপরান্ত দেশ বিস্তৃত ছিল। মহাভারত এক জায়গায় যেমন আভীরদের অপরান্তের অধিবাসী বলে উল্লেখ করেছে, তেমনই আরেক জায়গায় বলেছে–আভীররা থাকতেন বিনশন নামে একটি জায়গায় যেখানে সরস্বতী নদী তার জলধারা হারিয়ে ফেলেছে। পণ্ডিতদের মতে জায়গাটা দক্ষিণ-পশ্চিম রাজপুতানা। আরও আশ্চর্য হবেন শুনে যে, কোযকার পুরুষোত্তম দেব তার ত্রিকাণ্ডশেষ নামক গ্রন্থে বিনশন নামের জায়গাটিকে কুরুক্ষেত্রের মধ্যে ফেলেছেন। সত্য কথা বলতে কি ইতিহাসের প্রমাণেই বলা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দীগুলিতেই আভীররা ভারতবর্ষের জন-শরীরে মিশে গেছেন, নইলে পুরাণে সাতবাহন রাজাদের বংশধর হিসেবে পেতাম না। অন্যদিকে শক মহাক্ষত্রপদের মধ্যে অনেক আভীর রাজার নামও ইতিহাসেই পাওয়া যাবে।
আভীরদের বাসস্থানের বিস্তৃতি, তাদের ক্ষমতাশালিতা এবং তাদের রাজার আভিজাত্য নির্ণয় করে আমরা শুধু একটা কথাই বোঝাতে চাইছি, তা হল যদু-বৃষ্ণি সংঘের অভিজাত পুরুষেরা যেসব জায়গায় থাকতেন তাদের সঙ্গে আভীরজাতীয়দের অতিনৈকট্য কোনও অসম্ভব ঘটনা নয়। এ কথাটা আরও পরিষ্কার করে বলতে চাই এইভাবে যে, মহামতি বসুদেব যাদবদের মধ্যে অন্যতম প্রধান পুরুষ হয়েও যেখানে তিনি তাঁর পুত্রকে মানুষ হবার জন্য রেখে এসেছিলেন, সেই আভীরজাতীয় গোপজনেরাও সমাজে যথেষ্ট আদরণীয় পুরুষ ছিলেন এবং তাদের সঙ্গে যাদবদের নিত্য মেলামেশা এবং নিত্য যাতায়াত ছিল আত্মীয়-স্বজনের মতোই।
ইতিহাসের পাতায় শক-কুষাণ-আভীরদের তথাকথিত বৈদেশিকত্ব এবং এদেশে তাদের আভিজাত্যে উত্তরণের সূত্র ধরেই জানাই যে, ভারতবর্ষে কুষাণ যুগের প্রথম পর্বেই মথুরার স্থাপত্য-শিল্পে দেখতে পাচ্ছি–মহামতি বসুদেব নন্দগোপের হাতে তার প্রিয় পুত্রকে তুলে দিচ্ছেন। শেষ নাগের ছত্রছায়ায় বসুদেব যমুনা পার হয়ে বৃন্দাবনের দিকে যাচ্ছেন–এই দৃশ্যও কুষাণ যুগের পরিকল্পনা। স্থাপত্য-শিল্পের এই রীতি পরবর্তীকালে লিখিত ব্রাহ্মণ্য পুরাণের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়। আমরা যদি এটা বুঝতে পারি যে, সাহিত্য এবং শিল্পের এই প্রেরণা কৃষ্ণ-জীবনের সত্য-ঘটনাগুলি থেকেই এসেছে, তাহলে ইতিহাসের প্রমাণে এটাও মেনে নিতে হবে যে, আভীর ব্রজবাসীদের সঙ্গে যাদবদের মেলামেশা এবং মাখামাখি ওই বসুদেবের সময়কালে এসেই সম্পন্ন হয়নি, এ সম্পর্ক অনেক দিনের।
এই নিকট সম্পর্কের কথায় আরও একটি তথ্য এখানেই নিবেদন করি। বৌদ্ধগ্রন্থ ঘটজাতকে দেখা যাবে–বাসুদেব (কৃষ্ণ) এবং তার ভাইরা সকলেই কংসের বোন দেবগভার ছেলে। দেবগ অবশ্যই পুরাণ-বর্ণিতা দেবকীর পরিবর্তিত রূপ। জাতক বলেছে–দেবগভার এই পুত্রগুলি পালনের জন্য যাঁর হাতে সঁপে দেওয়া হল, তিনি নাকি দেবকীর একজন পরিচারিকা। তার নাম নন্দগোপা। নন্দগোপা যে আমাদের পরম পরিচিত নন্দরাজার স্ত্রী যশোদা-মাই তাতেও কোনও সন্দেহের কারণ নেই। কিন্তু যশোদার নাম সরাসরি না করে জাতক তার নামের সঙ্গে নন্দ রাজার পূর্বপদটি জুড়ে দিলেও যশোদাকে আমাদের চিনতে অসুবিধে হয় না বটে কিন্তু নন্দগোপার স্বামীর নাম ঘট-জাতকে অন্ধক-বে। আমাদের বক্তব্য–জাতকের লেখক যদি ব্রাহ্মণ্য প্রভাবিত পৌরাণিক গাথাগুলির দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে থাকেন, তবে এই নন্দগোপার স্বামীটির অন্ধক-বেহ্নু নামটি আমাদের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
ঘট-জাতকের অন্যান্য সব সংবাদ ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থরচনার তথ্য এবং ধারার সঙ্গে মেলে না বলে পণ্ডিতজনেরা অনেকেই এই তথ্যগুলি উড়িয়ে দিতে চান। কিন্তু আমাদের ধারণা–যেহেতু মেলে না, সেইজন্যই তথ্য হিসেবে এবং ঐতিহাসিকতার কারণে ঘটজাতকের এই সংবাদ ভীষণ রকমের জরুরী।
দেখুন, আমরা সবাই জানি–কৃষ্ণ অন্ধক-বৃষ্ণি কুলেরই অন্যতম প্রধান পুরুষ–বৃষ্ণীণাং পরদেবতেতি বিদিতঃ। অন্যদিকে ঘটজাতকে নন্দগোপার স্বামীর অন্ধক-বে নামটি অন্ধক বৃষ্ণি বা অন্ধক-বিষ্ণু শব্দেরই অপরিমার্জিত রূপ। নন্দগোপার স্বামী যদি অন্ধক-বৃষ্ণি বংশের কেউ না হন অথবা অন্ধক-বৃষ্ণিদের সঙ্গে তার যদি কোনও মাখামাখি সম্বন্ধ না থাকে, তবে তার এই নাম কোথা থেকে আসবে। অতএব এটা বেশ অনুমান করা যায় যে, অন্ধকবৃষ্ণিদের সঙ্গে ব্রজরাজনন্দের এতটাই সম্পর্ক ছিল যে, তারা তাকে অন্ধক–বৃষ্ণিদেরই একজন বলে জানতেন। অভিজাত বসুদেবের সঙ্গে যশোদা বা নন্দগোপার স্বামী অন্ধক–বে নন্দের গভীর সম্বন্ধও তাই অকল্পনীয় তো নয়ই, বরঞ্চ এই গভীর সম্পর্কের জন্য তাঁর নামই অন্ধক–বে অর্থাৎ অন্ধক–বৃষ্ণি।
আমরা এর আগেই জানিয়েছি যে, যদুবংশীয় পুরুষদের সঙ্গে গোপালক আভীরদের গভীর সম্পর্ক ছিল। ঘট-জাতকের মতো ব্রাহ্মণ্য-রচনা বহির্ভূত গ্রন্থেও সেই প্রমাণ থেকে যাওয়ায় আমাদের পক্ষে অনুমান করা সহজ হয় যে, এই গভীর সম্পর্কের কারণেই যদুবংশীয় অভিজাত পুরুষ বসুদেব তাঁর পরম বন্ধু গোপালক নন্দর হাতে তার শিশু পুত্রের ভার ন্যস্ত করে নিঃসঙ্কোচে বলতে পারেন–দেখ বন্ধু! রৌহিণেয় বলরাম আমার বড় ছেলে, আর কৃষ্ণ হল তোমার ছোট ছেলেস চ পুত্রো মম জ্যায়ান্ কনীয়াংশ্চ তবাপ্যয়। তুমি এই দুজনকেই রক্ষা করো।