বিষ্ণুপুরাণ জানিয়েছে–মহাদেবের কাছ থেকে বর লাভ করে গাৰ্গ শৈশিরায়ণ যখন ফিরছেন, তখন এক যবন রাজা তাকে খুব যত্ন-আত্তি করে বাড়ি নিয়ে যান। যবনরাজ অপুত্রক ছিলেন এবং তার মহিষীর গর্ভে নিয়োগ-প্রথায় শৈশিরায়ণের ঔরসে পুত্র লাভ করেন। আমরা কিন্তু বিষ্ণুপুরাণের চাইতে এব্যাপারে হরিবংশ-ঠাকুরকেই বেশি বিশ্বাস করি। হরিবংশের তথ্য একেবারেই আলাদা এবং সেটাই আমাদের কাছে বেশি বিশ্বাসযোগ্য।
আপনারা প্রথমে বিষ্ণুপুরাণের শ্লোকে একটি শব্দ লক্ষ্য করুন। দেখুন, আগে যে শ্লোকটি বিষ্ণুপুরাণ থেকে উল্লেখ করেছি, সেখানে শৈশিরায়ণের শ্যালক যেখানে দাঁড়িয়ে যাদবদের কাছে তার জামাইবাবুকে কটাক্ষ করছেন, সে জায়গাটা নাকি গোষ্ঠ। গোষ্ঠ মানে তা গো-চারণক্ষেত্র। কোনওভাবেই কি ভাবা যায় যে মথুরাবাসী যাদবরা গোচারণক্ষেত্রে বা তার কাছাকাছি থাকতেন? আমাদের বিশ্বাস–জায়গাটা বৃন্দাবন। মথুরা থেকে এক রাত্তিরে যেখানে বসুদেব কৃষ্ণকে রাখতে এসেছিলেন, যে জায়গাটা তো দূরে নয়, অতএব যাদবদের সেখানে যাতায়াত অথবা সেখানেই বেশ কিছু যাদবদের বসবাসও কিছু অসম্ভব নয়। ধরেই নিতে পারি বৃন্দাবনও যাদবদের অধ্যুষিত এলাকা ছিল এবং তা মাথুর কংসের করদ রাজ্য। এবার হরিবংশের তথ্য শুনুন।
হরিবংশ এক জায়গায় এটা স্বীকার করেছে যে, গার্গ শৈশিরায়ণ বার বছর মহাদেবের তপস্যা করেছেন এবং মথুরাবাসী যাদবদের অবধ্য একটি পুত্রলাভের বরও পেয়েছেন মহাদেবের কাছ থেকে। কিন্তু এখানে তিনি কোনও যবন রাজার গৃহে অতিথি হননি। তিনি হয়তো ফিরে এসেছেন নিজের জায়গায় যাদবদের কাছেই। কিন্তু এই বারো বচ্ছর পরেও তিনি তার পূর্বাপবাদ থেকে মুক্ত হননি। তাকে আবারও শুনতে হল যে, তিনি নপুংসক তেজোহীন পুরুষ–মিথ্যাভিশপ্তো…গার্গস্তু…বর্ষে দ্বাদশমে তথা।
হরিবংশ জানাচ্ছে–এই মিথ্যা অপবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ক্রোধে কৃষ্ণবর্ণ হয়ে গেলেন এবং নিজেকে সপ্রমাণ করার জন্য ক্রোধের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তিনি এক গোপন্যাকে আলিঙ্গন করে রমণ করতে লাগলেন–গোপন্যাম্ উপাদায় মৈথুনায়োপচক্ৰমে। এই গোপ-কন্যার কথা শুনে জায়গাটাকে তো সেই বিষ্ণুপুরাণ-কথিত গোষ্ঠই মনে হচ্ছে। গোপন্যার নামটিও দেখুন হরিবংশে গোপালী, গোপীস্ত্রীবেশধারিণী, অর্থাৎ সে কন্যার বেশবাসও গোপস্ত্রীদের মতো। এই গোপকন্যা গোপালীই শৈশিরায়ণের তেজ ধারণ করে জন্ম দিলেন কাল-যবনকে। কাল-বনের সঙ্গে মথুরাবাসীদের বিবাদ তথা কৃষ্ণের সঙ্গে তার ঝগড়া-ঝাটির কথা পরে আসবে। হরিবংশে আছে–গোপালীর ঘরে এই শিশু পুত্রের জন্ম দিয়ে গার্গ শৈশিরায়ণ নিজের অপবাদ স্খলন করলেন বটে কিন্তু পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে তিনি মথুরায় এলেন না। সে মানুষ হতে লাগল এক যবন রাজার ঘরে। যবন রাজার পুত্র ছিল না, অতএব যবনরাজার জাতি নামেই সেই পুত্রের নাম হল কাল-যবন।
হরিবংশের জবানি আমাদের কাছে এইজন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, মহাত্মা গার্গ শৈশিরায়ণ–তিনি ভরতবংশীয় ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণই হোন অথবা যাদবদের কুলপুরোহিতই হোন–তিনি যে মথুরাবাসী এবং যদু-বৃষ্ণি সংঘে তিনি যে এক অভিজাত মান্য পুরুষ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর ঠিক এইখানেই আমাদের প্রশ্ন হল যে, মাথুর যাদবদের মান্য পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে তেজস্কর প্রমাণ করার জন্য তিনি কি হাতের কাছে অন্য কোনও স্ত্রীলোক খুঁজে পেলেন না, একটি গোপকন্যাই শুধু খুঁজে পেলেন। পুরাণকারেরা অভিজাত গাৰ্গ পুরুষের মান বাঁচানোর জন্য গোপকন্যা গোপালীকে স্বর্গের অপ্সরা বলে জাতে তুলেছেন। কিন্তু একথা মনে রাখতে হবে–এই সম্মাননা যে কোনও বিরাট পুরুষের সাহচর্যেই সম্ভব। কোনও কোনও পুরাণের প্রমাণে অনেক দার্শনিকেরা পর্যন্ত ভগবান কৃষ্ণের নমসহচরী গোপ-রমণীদের স্বর্গের অপ্সরা বলেছেন, এমনকি স্ববেশ্যাও বলেছেন। কিন্তু আমাদের কথাটা এখানে নয়।
আমাদের বক্তব্য গার্গ শৈশিরায়ণ মাথুর যাদবদের ঘরের লোক হওয়া সত্ত্বেও যেহেতু এক গোপকন্যাকেই সন্নিকটে পেয়েছেন, তাতে অনুমান হয় গোপালক বা গোপালিকারা যাদব-বৃষ্ণিদের নিকট-জন ছিলেন। গোপালক আভীর জাতির সঙ্গে যাদবদের দহরম–মহরম অনেক আগে থেকে ছিল বলেই একটি গোষ্ঠ-প্রস্থের মধ্যে যাদবরা যেমন গার্গ শৈশিরায়ণকে উপহাস করতে পেরেছেন, তেমনই গোপালক নদ-রাজার ঘরে যাদব বসুদেবের পুত্র কৃষ্ণের পালন-পোষণও কিছু আশ্চর্য নয়।
শক-জাতীয়রা যে সময়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিলেন, তাদের সমসাময়িক কালেই আভীর-জাতীয় পুরুষেরা পূর্ব ইরানের কোনও জায়গা থেকে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেন বলে পণ্ডিতদের অনুমান। প্রতিবাদী পণ্ডিতেরা বলেন–অমন করে বৈদেশিকের সংজ্ঞা নির্ধারণ করলে মহামানবের এই সাগরতীরের মানুষেরা সকলেই বৈদেশিক হয়ে যাবেন। মহাভাষ্যকার পতঞ্জলি খ্রিষ্টপূর্ব দেড়শ শতাব্দীতে যেহেতু আভীরদের শূদ্রবর্ণের শাখা হিসেবে গণ্য করেছেন, তার মানে আভীরজাতীয়রা তার বহু আগে থেকেই ভারতবর্ষের সমাজে থিতু হয়ে গেছেন, নইলে জাতি-বর্ণের সামাজিক ব্যবস্থায় নবাগতদের স্থান হওয়া অত সহজ নয়।
মহাভারত এবং পুরাণগুলি আভীরদের স্থায়ী বাসস্থান নির্ণয় করেছেন অপরান্ত–দেশে। বৃহৎসংহিতার মতো প্রাচীন তথ্যপূর্ণ গ্রন্থে অপরান্ত-দেশকে কোঙ্কন, উত্তর-গুজরাত, কাথিয়াওয়াড়, কচ্ছ এবং সিন্ধুর সঙ্গে যুক্ত করা হলেও পৌরাণিকেরা জানিয়েছেন অপরান্ত হল ভারতবর্ষের পশ্চাদ্দেশ অর্থাৎ পশ্চিম ভারত। যে সমস্ত জনপদ এই অপরান্ত দেশের অন্তর্গত তার একটা তালিকা দিয়েছেন পুরাণকারেরা। এই তালিকার মধ্যে আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হল, সুরাষ্ট্র, কচ্ছীয়, আনর্ত ইত্যাদি অর্থাৎ ভারতবর্ষের পশ্চিমে যে কোস্টাল রিজিয়ন সেইগুলি। আমাদের কাছে এগুলি এইজন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, ভবিষ্যতে এই সব অঞ্চলে বিশেষত দ্বারকায় মহাভারতের প্রধান নায়ক কৃষ্ণকে নায়কত্ব করতে দেখা যাবে। তার মানে বৃন্দাবন-মথুরা ছেড়ে কৃষ্ণ যখন দ্বারকায়, তখনও তার সঙ্গে আভীর-ব্রজবাসীদের সম্পর্ক চুকে গেছে–এমন ভাবার কোনও কারণ নেই।