ত্রিগর্ত দেশের রাজার এক কন্যা ছিল। তার স্বামী হলেন গর্গ বংশীয় শৈশিরায়ণ-কন্যা ত্রিৰ্গতরাজস্য ভর্তা বৈ শৈশিরায়ণঃ। এই শ্লোকের পরে হরিবংশে গর্গবংশীয় শৈশিরায়ণের বংশ-বর্ণনা আছে।
আমাদের জিজ্ঞাসা হয়–পৌরাণিক কথক-ঠাকুররা বংশ-প্রতিবংশ বর্ণনার জন্য বিখ্যাত ছিলেন এবং তারা এত বোকা নন যে, বসুদেবের বংশপরম্পরা বলতে বলতে হঠাৎ ক্রম গুলিয়ে কোন এক গর্গবংশীয় ব্যক্তির নাম করতে যাবেন। আমাদের অনুমানের কথা বলি–বসুদেবের সঙ্গে এই গর্গগোত্রীয় শৈশিরায়ণের কোনও রক্তের সম্বন্ধ নেই বলেই আপাতত মনে হয়। কিন্তু একথা সকলেই জানেন যে, গর্গ ছিলেন যাদবদের কুল-পুরোহিত। লোকমুখে এমন পাঁচালিও শুনেছি যে–কৃষ্ণ নাম রাখে গর্গ ধ্যানেতে জানিয়া, অর্থাৎ কৃষ্ণের নামকরণও করেছেন ওই গর্গ। এই গর্গ মানুষটি কে? পুরাণগুলিতে আমরা একজন গর্গকে পাচ্ছি যিনি পাণ্ডব-কৌরবদের অতি পূর্ব পিতামহ পুরু-ভরতের বংশে জন্মেছিলেন।
আপনাদের মনে পড়ে কি–সেই যে মহারাজ ভরত তার কোনও পুত্রকে রাজ্য দিলেন না। শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজের পুত্র বিতথ ভরদ্বাজকে দিয়ে ভরতবংশের ধারা চলল। বিষ্ণুপুরাণ জানিয়েছে–এই বিতথের নাতিদের মধ্যে একজন ছিলেন গর্গ। রাজধর্মে তার মন ছিল না। অতএব তিনি ব্রাহ্মণ হয়ে যান। তার পুত্রেরাও সব ব্রাহ্মণ। ক্ষত্রিয়ের ঘরে জন্মেও ব্রাহ্মণের বৃত্তি গ্রহণ করেন বলে পৌরাণিকেরা তাদের ক্ষত্রিয়-বামুন বলত। বিষ্ণুপুরাণের ভাষায় গর্গাচ্ছিনি–স্ততো গার্গা শৈন্যাঃ ক্ষত্রোপেতা দ্বিজাতয়ো বর্ভূবুঃ। পারজিটার সাহেব গার্গ বা গর্গবংশীয়দের Ksatrian Brahman নামে অভিহিত করে মন্তব্য করেছেন–Even the Brahmnical Bhagavata says plainly that Gargya (Gargas) from a ksatriya became a brahman.
আমাদের ধারণা–এই ক্ষত্রিয়-বামুন গর্গ বা গার্গদেরই বংশের কোনও একজন যাদবদের কুল-পুরোহিত হয়েছেন পরবর্তী কালে। পূর্বে আমরা যে গর্গগোত্রীয় শৈশিরায়ণের নাম করেছি, তাকে তার পুত্রজন্মের প্রসঙ্গে একবার মাত্র হরিবংশে গর্গ শৈশিরায়ণ বলা হয়েছে বটে, তবে অন্য দুই জায়গায় ওই একই প্রসঙ্গে তাকে শুধুই গার্গ বলা হয়েছে, কিন্তু তার পুত্রের নাম তিন জায়গাতেই এক রকম। অর্থাৎ যদু বংশীয় বসুদেবের বংশ-পরম্পরা বলতে বলতে হঠাৎ গার্গ শৈশিরায়ণের পুত্রের যে নামটি পৌরাণিক বলেছেন, ঠিক সেই নামটিই অন্য দুই জায়গাতেও পাওয়া যাবে, যদিও পিতার নাম সেখানে শুধু গাৰ্গ অর্থাৎ গর্গবংশীয় কেউ একজন; শৈশিরায়ণের নাম যে দুজায়গায় নেই অথচ পুত্রের নাম একই আছে।
আমাদের স্থির বিশ্বাস গর্গ পুরু-ভরত বংশে জন্মালেও বংশগত আত্মীয়তা হেতু তথা ব্রাহ্মণ-তপস্বী হয়ে যাবার দরুন তাঁর ব্রাহ্মণ পুত্রেরা কোনও এক সময় যাদবদের কুল পুরোহিত হয়ে যান। আমাদের আরও বিশ্বাস–যাদবদের মধ্যে থাকতে থাকতে এবং তাদের পৌরোহিত্য করতে করতে তারা যাদবদের অত্যন্ত কাছের মানুষ হয়ে যান এবং যদুবংশীয়দের মধ্যে তাদের বিবাহাদিও হতে থাকে। না হলে যদুবংশীয় বসুদেবের কথা প্রসঙ্গে গার্গ শৈশিরায়ণের কথা আসত না। এবারে শৈশিরায়ণের কথা বলি, তাতে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যাবে।
হরিবংশ আগেই জানিয়েছে যে গাৰ্গ শৈশিরায়ণ ত্রিগর্ত-রাজার মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। এই গার্গ শৈশিরায়ণ যদু-বৃষ্ণিদের একটি সংঘের কুল পুরোহিত ছিলেন। অবশ্যই। দুর্ভাগ্যবশত গার্গ শৈশিরায়ণের একটি শারীরিক দোষ ছিল। লোকে বলত, এমনকি যাদবরাও হয়তো তাদের কুলগুরুর আড়ালে বলত যে, শৈশিরায়ণের নাকি বীর্য স্থলন হত না। আরও দুর্ভাগ্য তার স্ত্রী ত্রিগর্তরাজকন্যা এবং শৈশিরায়ণের শ্যালক অর্থাৎ ত্রিগর্ত রাজার ছেলেও গার্গ শৈশিরায়ণকে তেজোহীন নপুংসক বলতেন। তারা বলতেন–শৈশিরায়ণের তেজ মুক্ত হয় না–জিজ্ঞাসাং পৌরুষে চক্রে ন চস্কন্ধূপৌরুষ।
অন্য লোকে বলে বলুক, কিন্তু নিজের স্ত্রী যদি স্বামীর পৌরুযে সন্দেহ করে তো কোন পুরুষের ভাল লাগে! অন্যদিকে ঘটনাটা তথাকথিতভাবে সত্য যদি হয়ই তবে সেই স্ত্রী-শ্যালকেরই বা কেমন লাগে। অন্তত বার বছর এইভাবে কেটেছে, যাতে স্ত্রী-শ্যালকের সন্দেহ বেড়েছে–বর্যে দ্বাদশমে তথা। গার্গ শৈশিরায়ণের শ্যালক বোনের দুঃখ দেখে কথাটা আর চেপেও রাখতে পারলেন না। বার বছর সহ্য করার পর তিনি যদুবংশীয় রাজপুরুষদের সামনে একদিন জামাইবাবু শৈশিরায়ণের সম্বন্ধে কটাক্ষ করে বললেন–ব্যাটা পুরুষ তো নয়ই।–অপুমানিতি রাজনি (ব্রহ্মপুরাণ)। ব্যাটা নপুংসক–গার্গঃ গোষ্ঠে দ্বিজং শ্যালঃ ষঢ় ইত্যুক্তবান্ দ্বিজঃ (বিষ্ণুপুরাণ)।
সমবেত যাদবদের সামনে এসব কথা বলায় তারাও খুবসে হা-হা করে হাসলেন–যদূনাং সন্নিধৌ সর্বে জহসুঃ সর্বর্যাদবাঃ। এ হাসির ফল ভাল হল না। গার্গ শৈশিরায়ণ শ্যালকের ওপর যতখানি ক্রুদ্ধ হলেন, তারচেয়ে অনেক বেশি ক্রুদ্ধ হলেন যাদবদের ওপর। বিষ্ণুপুরাণ অথবা হরিবংশ অন্যত্র যেমন বলেছে, তাতে এই কথা শুনে গার্গ শৈশিরায়ণের শরীর ক্রোধে কৃষ্ণবর্ণ হয়ে গেল। তিনি দক্ষিণ সমুদ্রের তীরে মহাদেবের তপস্যা করতে গেলেন মথুরাবাসী যাদবদের অবধ্য এক ভয়ঙ্কর পুত্র লাভের জন্য।