বৃন্দাবনবাসীরা কৃষ্ণকে বসুদেবের পুত্র বলে জেনে গেলেও নীতিনিপুণ কৃষ্ণ কিন্তু এখনই তাঁর প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করতে চান না। সকলের মর্যাদাময় প্রতিবচন শুনে তিনি সলঙ্কে হেসে জবাব দিলেন–আপনারা আমাকে যেমন ভয়ঙ্কর পরাক্রমশালী বলে ভাবছেন, সেই পরাক্রমশালিতার কথাটুকু মনে রেখেই আপনারা আমাকে দূরে সরিয়ে রাখবেন না, আমি আপনাদের স্বজাতির মানুষ, আমি আপনাদের আত্মীয়-বন্ধু–তথাইং নাবমন্তব্যঃ স্বজাতীয়য়াস্মি বান্ধবঃ।
কৃষ্ণ জানেন–তার সামনে এখন অনেক কাজ, তাতে বিপদও কিছু কম নয়। মথুরার রাজা কংস তার অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছেন মগধ রাজেশ্বর জরাসন্ধের প্ররোচনায়। জরাসন্ধের মতো অমন ক্ষমতাশালী ব্যক্তি তখন ভূভারতে নেই। মথুরা-রাজ কংস সেই জরাসন্ধের জামাই। জরাসন্ধের শক্তিতে শক্তিমান হায়ে সমগ্র উত্তর-পশ্চিম ভারতকে তিনি পূর্বভারতের অধীশ্বর জরাসন্ধের কাছে আনত রাখার কাজ করছেন মথুরায় বসে। যদুবংশের যে সমস্ত শাখা-প্রশাখা–যাদব, বৃষ্ণি, অন্ধক, ভোজ, কুকুর ইত্যাদি সমস্ত বংশের বৃদ্ধ পুরুষেরা এখন কংসের ভয়ে গর্তে লুকিয়ে আছেন। যাঁরা বা কংসের মন্ত্রিসভায় কাজ করছেন, তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, তারাও তা করছেন কংসের ভয়েই, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নয়।
এইরকম একটা রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এখনও কৃষ্ণের সময় হয়নি আত্মপরিচয় সম্পূর্ণ প্রকাশ করার। এদিকে বৃন্দাবনের গোপবৃদ্ধেরা জেনে গেছেন যে, তাদের অতিপরিচিত এবং তাদেরই প্রেমাধীন কৃষ্ণ তাদের কেউ নন। ব্রজবাসীদের এই অতিমর্যাদাময় ব্যবহার কৃষ্ণ এখন চাপা দিতে চাইছেন নিজের কারণে এবং তা রাজনৈতিক কারণেই বটে। তিনি ব্রজবাসীদের বুঝিয়ে বললেন–আমার বিষয়ে আসল সত্য কথাগুলি যদি সত্যিই আপনাদের জানতে হয়, তবে আরও কিছু কাল অপেক্ষা করুন–যদি তৃবশ্যং শ্রোতব্যং কালঃ সম্প্রতিপাল্যতাম্। সময় আসলে আমার পরিচয়, আমার সমস্ত তথ্য আপনারা শুনতে পাবেন এবং বাস্তবে আমি লোকটা কেমন, তাও তখন জানতে পারবেন–ততো ভবন্তঃ শ্রেষ্যন্তি মাঞ্চ দ্রক্ষন্তি তত্ত্বতঃ।
কৃষ্ণ এবার সপ্রণয়ে গোপজনের সঙ্গে আপন আত্মীয়তা প্রতিষ্ঠা করে বললেন–যদি এই বালক কৃষ্ণ আপনাদের কাছে সত্যিই আদরের পরিজন হয়, তবে আমার বিশেষ পরিচয় জেনেই বা আপনাদের লাভ কী, তার দরকারই বা কী আছে। বরঞ্চ এ বিষয়ে আপনারা যতটা চুপ করে থাকবেন, ততটাই আমাকে অনুগ্রহ করা হবে বলে জানবেন–পরিজ্ঞানেন কিং কাৰ্যং যদ্যেযোনুগ্রহো মম। কৃষ্ণের কথা শুনে ব্রজবাসীরা বুঝলেন যে তারা অতি-উৎসাহের বশে এবং অতি কৃতজ্ঞতাবোধে হয়তো কৃষ্ণের একটু ক্ষতিই করে ফেলেছেন। অতএব আর একটাও কথা না বাড়িয়ে সরল গোপবৃদ্ধরা সকলে সলজ্জে চোখ চেপে–যেন কৃষ্ণকে তারা দেখেইনি–এইভাবে চোখ বন্ধ করে মুখ বন্ধ করে যে যেখান থেকে এসেছিলেন চলে গেলেন–বদ্ধমৌনা দিশঃ সর্বে ভেজিরে পিহিতাননাঃ।
.
১১৮.
বৃন্দাবনের গোপালক ব্রজবাসীরা যেহেতু কৃষ্ণের আসল পরিচয় প্রায় বুঝেই ফেলেছে এবং কৃষ্ণও যেহেতু তাদের কাছে আত্মপরিচয় লুকিয়ে রাখতে চাইছেন, তখন এই নিরিখে দু-চার কথা এখনই আমাদের বলে নেওয়া দরকার। আচ্ছা, আপনাদের একথা কি একবারও মনে হয় না যে, মথুরাবাসী কৃষ্ণপিতা বসুদেব, যিনি নিঃসন্দেহে ক্ষত্রিয়–কুলপতি বলে পরিচিত, তার সঙ্গে ওই গয়লা–মোড়ল নন্দরাজার এত ভাব কিসের? তৎকালীন দিনের বর্ণ ব্যবস্থার উচ্চাবচ মর্যাদা মাথায় রেখে একবার ভাবুন তো যে, অভিজাত যদুবংশীয় পুরুষ বসুদেবের সঙ্গে তথাকথিত নীচ আভীর–জাতীয় নন্দরাজের এত মাখামাখি কেমন করে সম্ভব? এতটাই মাখামাখি যে, বসুদেব তার পৌরবী গৃহিণী রোহিণীকে নন্দগোপের বাড়িতে রেখে দিয়েছেন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। কেন যদু-বৃষ্ণিদের বিরাট সংঘ-পরিবারে আর কি কোনও অভিজাত মানুষ ছিলেন না, যাঁর ঘরে বসুদেব তার স্ত্রীকে গচ্ছিত রাখতে পারতেন কংসের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য।
শুধু স্ত্রীকে রেখে আসাই নয়, সেই নন্দ ঘোষের ঘরে বসুদেবের বড় ছেলে বলরাম জন্মেছেন এবং তারই ঘরে তিনি মানুষ হচ্ছেন; কৃষ্ণকেও মানুষ করার জন্য বসুদেব সেই নন্দ ঘোষকেই বেছে নিলেন। উচ্চ-নীচ জাতির এই প্রায় অসম্ভব মাখামাখি থেকেই আমাদের মতো সাধারণ জনের মনে সন্দেহ জাগে যে, ব্যাপারটা কী? এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়, তবে এবিষয়ে সম্ভাব্য কথাগুলি এখনই বলে নেওয়া ভাল।
প্রথম কথা হল–বৃন্দাবনের নন্দ ঘোষ গোপালন করে জীবিকা নির্বাহ করলেও তার অবস্থা ভাল ছিল এবং তিনি ছোট-খাট সামন্ত রাজা বলেই তার একটা মর্যাদাও ছিল। অত্যাচারী কংসকে তিনি রাজকর দিতেন এবং তা দেবার জন্য তাকে মথুরায় আসতে হত। কৃষ্ণকে যখন নন্দ-রাজার বাড়িতে রেখে আসা হল, তারপরেও নন্দ একবার রাজকর দিতে মথুরায় এসেছিলেন। তার প্রমাণও আছে পুরাণগুলিতে। এই তথ্য থেকে আরও প্রমাণিত হয় যে, বৃন্দাবন কংসের করদ রাজ্যের একটি। অথবা এটাকে রাজ্য না বলাই ভাল, বলা উচিত বৃন্দাবন নামক গ্রামটি কংসের অধীনেই ছিল এবং ব্রজবাসীরা কংসের করদ প্রজা।
এখন দেখতে হবে তথাকথিত নীচ কুলের আভীর ঘোষদের সঙ্গে মথুরাবাসী অভিজাত বসুদেবের এত মাখামাখি কেন? লক্ষ্য করে দেখুন–হরিবংশ, ব্রহ্মপুরাণ এবং আর দু-একটি প্রাচীন পুরাণে যখন বসুদেবের বংশপ্রণালী বলা হচ্ছে, সেখানে অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে এবং অত্যন্ত আকস্মিকভাবে এক গর্গবংশীয় পুরুষের নাম উল্লেখ করা হচ্ছে। এই উল্লেখের প্রসঙ্গটা এই রকম। গর্গবংশীয় পুরুষটির নাম করার আগে পর্যন্ত হরিবংশ ঠাকুর বসুদেবের অন্যান্য স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্রদের নাম বলছিলেন। বলা হয়েছে–বসুদেব অন্য এক স্ত্রী বৃদেবীর গর্ভে মহাত্মা অনাবহকে প্রসব করলেন। ঠিক এই শ্লোকের পরেই অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলা হল—